সংবাদ মাধ্যমের মুখ বন্ধ করে কি খুন-খারাবি বন্ধ করা যায়? কিম্বা মিডিয়া না দেখালেই কি রাজ্য থেকে খুন-খারাবি উঠে যাবে?
একমাত্র বহুদলীয় উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই মিডিয়া বা সংবাদ মাধ্যম স্বাধীনতা ভোগ করে যদিও রাষ্ট্র ভেদে সেই স্বাধীনতায় নানা রকম কমবেশি আছে। আমাদের দেশের সংবিধানে বাক বা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। মতামত প্রকাশের একটি অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সংবাদ মাধ্যম। কাজেই সংবাদ মাধ্যমের মত প্রকাশের স্বাধীনতাও সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত। ভারতে ৭৫-এর জরুরী অবস্থা বা এমার্জেন্সি ব্যতিরেকে রাষ্ট্র কখনও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে নি। যদিও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী থেকে বাহুবলী মাফিয়া, পুলিশ এমনকি পাড়ার পাতি মাস্তানদেরও বিরাগভাজন হওয়া সাংবাদিকদের অকুপেশনাল হ্যাজার্ডসের মধ্যেই পড়ে। নেতা-মন্ত্রী-বাহুবলীদের থ্রেট খাওয়াটা সাংবাদিকেরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না। ক্ষেত্র বিশেষে তাদের মার খেতে হয় কপাল খারাপ থাকলে খুনও।
গণতন্ত্রের একটা রূঢ় সত্য হল সংবাদ মাধ্যম স্বভাব নিন্দুক এবং সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গি সদা তির্যক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাঁরা সংবাদ মাধ্যমের এই ভূমিকা দেখে অভ্যস্ত। নিজের সমালোচনা শুনতে কারোরই খুব একটা ভাল লাগে না। সংবাদপত্র, চ্যানেল বা পোর্টালে যখন সরকারের তীব্র সমালোচনা হয় তখন সরকার প্রধানদের কর্ণেও সেটা আহামরি কিছু শ্রুতিমধুর লাগে না। কিন্তু তারপরেও তাঁরা সমালোচনা সহাস্য অথবা বিরস বদনে হজম করেন। কারণ এটাই গণতন্ত্রের আদত। গণতন্ত্রে সরকারের নিন্দা-সমালোচনা-কটাক্ষ করা পাপ বা রাষ্ট্রদ্রোহ নয়। বরং গণমাধ্যমের সমালোচনা সরকারকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সবথেকে বড় জায়গা যেই হেতু সংবাদ মাধ্যম সেই হেতু সংবাদ মাধ্যম সময় সময় সরকারের প্রতিপক্ষের রোল নিয়ে ফেলে ইচ্ছায় হোক কি অনিচ্ছায়। শুধু সরকার বা প্রশাসন নয় যে কোনও রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই মিডিয়ার সম্পর্ক এক তরফা প্রেম অথবা ঘৃণার নয় বরং অম্লমধুর যাকে ইংরেজিতে বলে লাভ-হেট রিলেশন। দেশে এমন কোনও রাজনৈতিক দল নেই যারা কখনও না কখনও সংবাদ মাধ্যমকে কাঠগড়ায় তোলে নি। সংবাদ মাধ্যম একটা বিরাট বড় পরিসর। এখন আবার সামাজিক মাধ্যমও এসেছে। যদিও সংবাদ মাধ্যমের জগতে নিরপেক্ষতা বলে একটা গালভারি কথা আছে কিন্তু সংবাদ পরিবেশনের বেলায় মিডিয়ায় মিডিয়ায় দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। মিডিয়া বিস্তর ভুলও করে এবং সমালোচনা তার ন্যায্য প্রাপ্যও বটে। জনগণ নিজেই সময় সময় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু তাই বলে আমার স্তুতি না করলেই মিডিয়া খারাপ! খুন-গণহত্যা-বোমাবাজি-ধর্ষণ-ধর্ষণ করে খুন রাজ্যে ঘটবে অথচ সে’সব নিয়ে আলোচনা করলেই মিডিয়া খারাপ!
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হঠাৎ করেই সংবাদ মাধ্যমের প্রতি চরম অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে বগটুই গণহত্যাকান্ডের পর থেকেই রাজনৈতিক বিরোধীদের পাশাপাশি মিডিয়াকেও টার্গেট করছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিরোধীদের নিন্দা-সমালোচনা করা তৃণমূল সুপ্রিমোর রাজনৈতিক দায় কিন্তু সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার করছেন কেন? সোমবার কলকাতার মিলনমেলা প্রাঙ্গণে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে বক্তৃতা দিতে গিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মিডিয়ার পেছনে সময় ব্যয় করেছেন আট মিনিটেরও বেশি। সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকেরা শাসক-বিরোধী নির্বিশেষে নেতাদের সমালোচনা শুনতে অভ্যস্ত। সংবাদপত্রকে কটাক্ষ করতেন বামেদের দুই মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যও। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতাও বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমের কমবেশি সমালোচনা করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তিনি যেভাবে মিডিয়াকে ধুয়ে দিচ্ছেন তা এক কথায় নজিরবিহীন।
সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সব থেকে বড় অভিযোগ- তারা ছোট ঘটনাকে বড় করে দেখিয়ে বাংলার ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা অপপ্রচার রটাচ্ছে। এখন কাউন্সিলর-উপপ্রধান খুন, উপপ্রধান খুনের জেরে নারকীয় গণহত্যা, দশজন নারী-শিশুকে পুড়িয়ে খুন, কিশোরীকে ধর্ষণ করে হত্যার মতো ঘটনা মিডিয়া কীভাবে চেপে যাবে? সংবাদ মাধ্যমের আরেক নাম গণমাধ্যম। নিতান্তই দলদাস না হলে কোনও বাণিজ্যিক গণমাধ্যমের পক্ষে কি সম্ভব এই সমস্ত গুরুতর ঘটনাকে লঘু করে দেখানো? মমতার অভিযোগ, টিআরপি বাড়ানোর লোভে চ্যানেলে চ্যানেলে এইসব ঘটনা দেখানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। জনগণ দেখলে তবে চ্যানেলের টিআরপি বাড়ে আর টিআরপি বাড়লে বিজ্ঞাপন বাড়ে। বিজ্ঞাপন বাড়লে চ্যানেলের আয় বাড়ে। সরকারের কাছে নাগরিকদের সব থেকে বড় প্রার্থনা নিরাপত্তা। সাধারণ মানুষ চায় তারা যেন বাইরে থেকে নিরাপদে ঘরে ফিরে রাতে শান্তিতে ঘুমোতে পারে। এই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে নাগরিকেরা আশঙ্কিত হবে না? জনগণের আশঙ্কার কথা সংবাদ মাধ্যম তুলে ধরতে পারবে না? পৃথিবীর কোনও গণতান্ত্রিক দেশে এই রকম পরিস্থিতিতে মিডিয়ার পক্ষে সম্ভব প্রশাসনের মনোরঞ্জন হয় এমন খবরই শুধু সম্প্রচার করা? হাথরসে ঘটলে মিডিয়া দেখালে ক্ষতি নেই আর হাঁসখালি নিয়ে লাইভ করলেই দোষ?
পশ্চিমবঙ্গে এখন সেই কাগজ-চ্যানেল-পোর্টালই সরকারি বিজ্ঞাপন পায় যারা সরকার খুশি হয় এমন খবরই কেবল বিতরণ করে। সোমবার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন- ” আমার তো মনে হয় যারা অ্যাডভারটাইসমেন্ট দেয়, তাদের চিন্তা করা উচিত এদের আদৌ অ্যাডভারটাইসমেন্ট দেওয়া উচিত কিনা। আমি না দিতে বলছি না। আপনি টাকা দিচ্ছেন আর ওরা টিআরপি বাড়াচ্ছে আর সারাক্ষণ খুন-খারাবি দেখিয়ে যাচ্ছে।” রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান যখন প্রকাশ্যে নাম করে নির্দিষ্ট কোনও চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতে বিজ্ঞাপনদাতাদের নিরুৎসাহিত করেন তখন তাকে বিজ্ঞাপনদাতাদের তরফে প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবে না দেখার কোনও কারণ থাকতে পারে কি?
সংবাদ মাধ্যমের মুখ বন্ধ করে কি খুন-খারাবি বন্ধ করা যায়? কিম্বা মিডিয়া না দেখালেই কি রাজ্য থেকে খুন-খারাবি উঠে যাবে? কোনও দিন কোনও দেশে এমন কান্ড ঘটেছে? অথচ সংবাদ মাধ্যমকে অযথা না বকে সংবাদ মাধ্যমে খুন-ধর্ষণ-বোমাবাজি-হিংসার খবর কম দেখানোর সব থেকে সহজ রাস্তাটা কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই আছে। আর সেটা হচ্ছে সুশাসন। মানুষ শান্তিতে থাকলে অশান্তির খবর কোথায় পাবেন সাংবাদিকেরা?
Photo Credit- Official FB page of Mamata Banerjee.