পুলিশ দায়িত্ব পালনে অবহেলা না করলে এই ঘটনা ঘটত না-বগটুইয়ে দাঁড়িয়ে স্বীকার করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
ডেস্ক রিপোর্ট :ভাদু শেখের খুনের পর পুলিশ সজাগ থাকলে সোমবার রাতে বগটুই গ্রামে গণহত্যা এড়ানো যেতো- বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে মেনে নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা ক্ষমতায় আসার পর এত ভয়ানক গণহত্যাকান্ড এই প্রথম। স্বভাবতই চাপে রাজ্য প্রশাসন। বিরোধীরা প্রতিবাদে পথে এবং কেউ ৩৫৫ তো কেউ ৩৫৬ চেয়ে দিল্লিতে কেন্দ্রের দরবারে। বুধবারই মুখ খুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে রাজ্যকে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এদিন বগটুই পরিদর্শনে গিয়ে যেন নিজের প্রশাসনের উপরেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
বগটুইকান্ডের জেরে প্রথম চোটেই ক্লোজ করা হয় রামপুরহাট থানার আইসি এবং ওসিকে। বৃহস্পতিবার মমতার বগটুই পরিদর্শনের দিন আইসি ত্রিদীপ প্রামাণিককে সাসপেন্ডও করল ভবানী ভবন। অপসারণ করা হয় এসডিপিওকেও। পরে গাফিলতির অভিযোগে ডিস্ট্রিক্ট ইন্টেলিজেন্স অফিসারকেও ( ডিআইও) সাসপেন্ড করেছে সরকার। সেই সঙ্গে চাকরি গেছে ১১জন সিভিক ভলান্টিয়ারেরও। বৃহস্পতিবার সকালে হাওড়ার ডুমুরজলা স্টেডিয়াম থেকে হেলিকপ্টারে চাপেন মমতা। হেলিকপ্টার নামে রামপুরহাট সার্কিট হাউসের মাঠে। সেখান থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে কনভয় ছোটে বগটুই গ্রামে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গ্রামেই নিহতদের পরিবারদের মুখোমুখি হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যের পুলিশমন্ত্রীও মমতা। বগটুইয়ে নরসংহারের দায়ে তাঁর পদত্যাগ চেয়েছে বিরোধীরা। এদিন পুলিশমন্ত্রীকে বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে স্বীকার করতে হল নিজের পুলিশের ব্যর্থতার কথা। তিনি বলতে বাধ্য হন- “তারা নেগলেক্ট না করলে এই ঘটনা ঘটত না। সঙ্গে সঙ্গে যদি পুলিশ পিকেটিংটা দিত এমন ঘটনা ঘটত না। কিন্তু পুলিশ পিকেটিং দেয় নি। “ আসলে বগটুইয়ের গণহত্যায় পুলিশের গাফিলতির প্রমাণগুলি এতই সুস্পষ্ট যে স্বীকার না করে সরকারের মুখ রক্ষার আর কোনও উপায় ছিল না মমতার সামনে। এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। যদিও তিনি মনে করেন, ”কয়েকটা লোকের জন্য টোটাল ফোর্সের বদনাম হচ্ছে। ” হিংসার শিকার গ্রামবাসীদের মুখ্যমন্ত্রী বলেন,“আমি ভাবতে পারি নি এরকম নৃশংস ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা আজকে আধুনিক যুগে যাচ্ছি। সারা বিশ্বে যুদ্ধ হচ্ছে। আর এখানে অশান্তির আগুন। শুধু কয়েকটা লোকের জন্য। “
পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে কড়া কথা বলার পাশাপাশি রামপুরহাট ব্লক তৃণমূলের সভাপতি আনারুল হোসেনের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ বিনা যে বগটুইয়ের সব হারানো জনতা শান্ত হবে না তা মমতা ঘটনাস্থলে রওনা হওয়ার আগেই বুঝে যান। তাই গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আনারুলকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনার পর থেকেই আনারুলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ চড়ছিল মানুষের। আনারুল হোসেনের মদতেই বগটুইয়ের পশ্চিমপাড়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে বলে ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রী বলেন,” আনারুল আমাদের ব্লক প্রেসিডেন্ট। তাঁকে কমপ্লেন করেছিল ওরা( আক্রান্তরা)। কিন্তু আনারুল সময় মতো পুলিশ পাঠায় নি । ওকে অ্যারেস্ট করা হবে। কেন ও পুলিশ পাঠায় নি সময় মতো। পুলিশ পাঠালে ঘটনাটা নাও ঘটতে পারত। “ এরপর অপসারিত এসডিপিও-র দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন মমতা। তিনি বলেন,“এখানকার যে এসডিপিও ছিল। তিনি ঘটনা যখন দেখলেন। একজন খুন হয়ে গেল। খুন হয়ে যাওয়ার পরেও তাঁর প্রিকশন নেওয়া উচিত ছিল, যাতে আর কোনও ঘটনা না ঘটে। ” রামপুরহাটের আইনশৃঙ্খলা যে ভালো নয় তাও মেনে নেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং তার পেছনে যে পুলিশের গাফিলতি আছে তাও মেনে নিয়ে মমতা বলেন, “এই গ্রামে আগেও অনেক খুন-খারাবি হয়েছে। এসডিপিও তার দায়িত্ব পালন করে নি। আইসিও তার দায়িত্ব পালন করে নি। ডিআইবির অফিসারও তার দায়িত্ব পালন করে নি। সুতরাং যারা যারা দায়িত্ব পালন করে নি। এবং এই ঘটনা ঘটতে পারে জেনেশুনেও যারা পুলিশকে ঠিকমতো কাজে লাগায় নি, আমি তাদের কঠোর শাস্তি চাই। “
ভাদু শেখের খুন এবং খুনের জেরে নরসংহারের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ধৃতরা যাতে সহজে জামিন না পায় তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “খুন হওয়াটাও খারাপ। অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে মারাটাও খারাপ। দুটো ঘটনাকেই আমি কনডেম করছি। “ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারি নিয়ে তিনি যে কোনও ওজর-আপত্তি শুনতে নারাজ এদিন তাও স্পষ্ট করে দেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি কিন্তু কোনও কথা শুনতে চাই না যে, একে পেলাম না। ওকে পেলাম না। দু’জন পালিয়ে গেছে। যেখানেই পালাক ধরে আনতে হবে। ” আবারও আনারুলের প্রসঙ্গ তুলে মমতা বলেন, “আনারুল অ্যারেস্ট হবে। আইদার ও সারেন্ডার করবে থানায় গিয়ে। নইলে ওকে যেখান থেকে পাবেন অ্যারেস্ট করবেন। “ মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই তারাপীঠ থেকে আনারুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বগটুইকান্ডে এখনও পর্যন্ত একুশজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে রাজ্য প্রশাসন জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার বগটুইয়ে দাঁড়িয়ে নিহতদের পরিবার, আহত ও আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের কথাও ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা জানান, মৃতদের পরিবার পিছু ৫ লক্ষ করে টাকা দেওয়া হবে। আগুনে যাদের পোড়া ষাট শতাংশ বা তার অধিক তাদের এক লক্ষ করে টাকা দিবে সরকার। অগ্নিদগ্ধ বাড়ি পুনর্নির্মাণে ১ লক্ষ টাকা প্রয়োজনে বাড়িয়ে দুই লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। আগুনে পুড়ে জখম তিন শিশুকে ৫০ হাজার করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। আহতদের চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব সরকারের। মৃতদের পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার কথাও জানান মমতা। চতুর্থ শ্রেণীর সেই চাকরিতে প্রথমে মাসে ১০ হাজার টাকা করে বেতন মিললেও এক বছর পরে নিয়োগ স্থায়ী করে দেবে সরকার।
বুধবার বগটুইয়ে গণহত্যার পেছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন রামপুরহাটে গিয়ে মমতা বিরোধীদের সমালোচনায় শব্দ খরচ না করলেও বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের কথা তুলতে ভুলেন নি। তিনি বলেন, “এখনও যে মেয়েরা, বাচ্চারা বেঁচে আছে, যেকোনও সময় গুন্ডা নিয়ে এসে বাইরে থেকে তাদের অ্যাটাক করতে পারে। বৃহত্তর ষড়যন্ত্র আছে এখানে। সুতরাং এই খানে ভাল করে পিকেটিং রাখতে হবে। “
গোটা বাংলা যে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরণের উপর দাঁড়িয়ে আছে, বগটুইকান্ডের পর মমতা এটা বুঝতে পেরেছেন বলেই মনে হয়। বগটুইয়ে দাঁড়িয়েই মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন-“সারা বাংলায় তল্লাশি চালাও। যেখানে বোমা আছে। যেখানে যন্ত্রপাতি আছে সব উদ্ধার করতে হবে। “ নিজের পুলিশের পারফরম্যান্সে মুখ্যমন্ত্রী কতটা ক্ষুব্ধ বোঝা যায় যখন তিনি বলেন- “যে অ্যাক্টিভলি কাজ করবে পুলিশ বিভাগ তাকে সেলাম জানাবে। আর যে অ্যাক্টিভলি কাজ করবে না। এনজয় করে বেড়াবে। তার পুলিশের চাকরি করার প্রয়োজন নেই। খুন-খারাবি বন্ধ করতে হবে। দু’জন অন্যায় করবে। তার জন্য টোটাল ফোর্সটাকে কেউ দোষ দেবে। সেটা হতে পারে না। “