বিশেষ প্রতিবেদন – ১৯৮৭ পর ২০২১ । মাঝে সেই বছর ৩৪ এর ব্যবধান । একই বাংলার দুই নির্বাচনের মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে । জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের দশ বছরের মেয়াদ শেষে সাতাশির মে মাসে অনুষ্ঠিত হল দশম বিধানসভা নির্বাচন । এর বছর খানেক আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গকে পাখির চোখ করেছিলেন রাজীব গান্ধী । সাতাত্তরের বিধানসভায় শোচনীয় পরাজয়ের পর পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সংগঠন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী সহ কংগ্রেসের অনেক নেতা ইন্দিরার হাত ছেড়ে দেবরাজ আর্সের কংগ্রেসে নাম লেখান । বিরাশির বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের কাছে দুর্বল ইন্দিরা কংগ্রেস প্রত্যাশিত পরাজয় বরণ করে । সাতাত্তরের ঐতিহাসিক পরাজয়ের আড়াই বছরের মাথায় সগৌরবে দিল্লির মসনদে ফিরলেও পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে টলিয়ে দেওয়ার কথা কখনও সিরিয়াসলি ভাবেন নি ইন্দিরা গান্ধী । ১৯৮৪তে লোকসভা নির্বাচনের মাস দুয়েক আগে নিজের শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হলেন ইন্দিরা । প্রবল সহানুভূতি হাওয়ায় ভোটে গোটা দেশ থেকে কার্যত সাফ হয়ে যায় বিরোধীরা । ইন্দিরা ঝড় পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টকে ধরাশায়ী না করতে পারলেও গাছটাকে নাড়িয়ে ছাড়ল । অসংখ্য ডালপালা ভেঙে পড়ল । বেয়াল্লিশটি আসনের মধ্যে ১৬ টি আসন ছিনিয়ে নিল কংগ্রেস । এখানে বলে রাখা দরকার , সাতাত্তরে স্টুডেন্ট পলিটিক্স দিয়ে রাজনৈতিক জীবনে মমতার হাতেখড়ি হলেও সংসদীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ কিন্তু চুরাশিতেই যাদবপুরের লালদুর্গে হেভিওয়েট সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে । চুরাশির ডিসেম্বরে লোকসভা ভোটে বড় ধাক্কা খাওয়ার পর সাতাশির বিধানসভা নির্বাচন নিঃসন্দেহে বামফ্রন্টের জন্য ছিল কঠিন পরীক্ষা । ছেয়াশি সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকারকে টার্গেট করে মাঠে নেমে যান প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী , যেমন ভাবে উনিশের লোকসভা ভোটে দলের নজরকাড়া পারফরমেন্সের পর আদাজল খেয়ে পশ্চিমবঙ্গের ফিল্ডে নেমে পড়েছিলেন মোদী-শাহ , কতকটা সেভাবেই ।
১৯৮৩ তেই কংগ্রেস ( এস ) ছেড়ে ইন্দিরা কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন করেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী । ১৯৮৪র ভোটে হাওড়া থেকে জিতে সংসদেও যান প্রিয় । পঁচাশিতে রাজীবের মন্ত্রিসভাতেও ঠাঁই পেয়েছিলেন তিনি । পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সবথেকে ক্যারিশ্মাটিক ও বাগ্মী এই নেতাকে প্রদেশ কংগ্রেসের মাথায় বসিয়ে দিয়ে বাংলা থেকে সিপিএমকে হটানোর পরিকল্পনা শুরু করে দেন রাজীব । সাতাশিতে বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই ঘন ঘন পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসতে থাকেন রাজীব গান্ধী । জ্যোতি বসুর দশ বছরের শাসন পূর্ণ হওয়ার মুখে গণতন্ত্রের নিয়ম মেনেই বাংলার বাতাসে খানিকটা অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সির গন্ধ উঠেছিল । এই হাওয়ায় ভর করেই বামফ্রন্টকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে কংগ্রেস । দিল্লি থেকে রসদ পেয়ে প্রিয় ঝাঁপিয়ে পড়েন লাল বাংলাকে সবুজ করতে ।
১৯৮৭’র বিধানসভা : সেবার রাজীবের দিলীপ ঘোষ হয়েছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী । |
৩৪ বছরের শাসনে মোট তিনটি বিধানসভা ভোটে চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টকে । ২০০১ এর নির্বাচনের আগে সাতাশিই ছিল প্রথম নির্বাচন যেটা জিততে বেগ পেতে হয়েছিল বাম নেতৃত্বকে । ২০১১র ভোট ছিল ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের জন্য শেষ চ্যালেঞ্জের । মমতার কাছে সেই চ্যালেঞ্জে হেরে অবশেষে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেয় বাংলার বাম রাজত্ব। কিন্তু ১৯৮৭ তে বামফ্রন্টকে মহাকরণ থেকে টলাতে পারে নি দিল্লির রাজীব গান্ধী । প্রচারে এসে মা-বাবা উভয়েরই বন্ধু জ্যোতি বসুর উদ্দেশ্যে কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়ে রাজীব বলেছিলেন, ‘ আপনাকে রিটায়ার্ড না করিয়ে বাংলা থেকে ফিরছি না । ‘ পাল্টা বাক্যবান ছুঁড়ে জ্যোতি বসু বলেছিলেন , ‘ আমি রিটায়ার্ড করব না রাজীবকেই পলিটিক্স থেকে রিটায়ার্ড করিয়ে ছাড়ব । ‘ পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনটা হয়ে দাঁড়ালো প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ভার্সেস মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সম্মান রক্ষার লড়াই ।
৮৭’র বিধানসভা ভোটও হয়ে উঠেছিল দিল্লি বনাম বাংলার লড়াই । |
উনিশের মতো একই রকম টান টান উত্তেজনায় মোড়া সাতাশির বিধানসভা ভোটের রেজাল্ট যখন বেরুতে শুরু করল , তখন দেখা গেল রাজীবের সব কোশিস বিলকুল জলে । সেবারও কংগ্রেসের সমর্থকেরা ধরেই নিয়েছিলেন মহাকরণ দখল সময়ের অপেক্ষা মাত্র । গণনার দিন পাড় সিপিএম সমর্থকেরাও দুরু দুরু বক্ষে ফলের প্রতীক্ষায় ছিলেন । খবরের কাগজ এবং কংগ্রেস এমনকি বাম সমর্থকদেরও সব হিসেব নিকেশ উল্টে দিয়ে সাতাশির নির্বাচনে বিপুল ভোটে মহাকরণে ফেরে বামফ্রন্ট । সিপিএমের সংগঠন আর জ্যোতি বসুর ক্যারিশ্মার কাছে সেদিন ম্লান হয়ে যায় রাজীবের পরিবর্তনের ডাক । ৫২.৯৬ শতাংশ রেকর্ড ভোট পেয়ে সেবার ক্ষমতায় আসে বামেরা । চৌত্রিশ বছরের শাসনে এটাই বামেদের সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্তি । ৪১.৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে কংগ্রেসের জোটে মাত্র চল্লিশটি আসন । বামফ্রন্ট পেয়েছিল ২৫১টি আসন । সিপিএম একাই ১৮৭ । ভোটে ভরাডুবির দায় মাথায় নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী ।
একুশে বাংলা দখল পাখির চোখ করেও ব্যর্থ মোদী : বাংলার রাজনীতির ডিএনএ-টাই কেন্দ্র বিরোধী । |
একুশে তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরার পথে তৃণমূলের সামনেও একই রকম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার । বরং সাতাশিতে জ্যোতি বসুকে হারাতে যতটা শক্তি রাজীব গান্ধী খরচ করেছিলেন তার থেকে অনেক অনেক বেশি শক্তি খরচ নরেন্দ্র মোদী – অমিত শাহ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হটাতে । কিন্তু গণতন্ত্রে বিধাতা জনগণ । বড় করে পাত পাতলেই ওপর থেকে জনগণেশের প্রসাদ বেশি করে পড়বে এমন কোনও কথা নেই । বাংলার মানুষের ডিএনএটাই মনে হয় কেন্দ্র বিরোধী । সাতাশি আর একুশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন নিঃসন্দেহে। কিন্তু যেটা মিল , সেটা এই যে দিল্লির শক্তি অত্যধিক প্রয়োগ করে বাংলার অভ্যন্তরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন সাতাশিতেও সফল হয় নি , একুশেও সফল হল না ।
Photo Credit – moneycontrol.com