বিশেষ প্রতিবেদন: ৫ অগাস্টের পর বাংলাদেশ একজন নয়া ‘রাষ্ট্রগুরু’ পেয়েছে। নাম মাহফুজ আলম। যদিও প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূসের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরের আগে সেই ভাবে মাহফুজের নাম বাজারে আসে নাই। সেই সফরে মাহফুজ আলম ছিলেন ইউনূসের সঙ্গী। আমেরিকায় এক অনুষ্ঠানে মাহফুজকে জুলাই বিপ্লবের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ইউনূস। ইউনূস সাহেব গদগদ স্বরে একা মাহফুজকেই বিপ্লবের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বানিয়ে দেওয়ায় বাকি সমন্বয়কদের অনেকেই তখন মাইন্ড করেছিলেন। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর পদ থেকে প্রোমোশন পেয়ে মাহফুজ আলম এখন ইউনূস সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা।
রবিবার বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতরে গিয়ে দেশের বিদেশ নীতি নিয়ে অনেক শব্দ খরচ করেন মাহফুজ। মহম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা থাকলেও অলিখিতভাবে মাহফুজই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন বলে মনে হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাঁড়িয়ে মাহফুজ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে না বলে শুনতে পেয়েছি। তখন মাহফুজের এক পাশে দাঁড়িয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, অন্য পাশে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীমউদ্দীন। মাহফুজ আলম বলেন, “এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ওনারা (ভারত) নিয়েছেন, ওনারা (ভারত) ওনাকে (শেখ হাসিনাকে) ফেরত দেবে না। এটা আমরা শুনতে পাচ্ছি।”
মাহফুজ কি তবে ম্যাচিউরড হইল?
ভারত যে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে না, বাংলাদেশের একটা শিশুও তা জানে। মাস্টারমাইন্ড মাহফুজ জানবে না কেন। মাত্র দিন সাতেক আগেই শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়ে সাউথ ব্লককে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনার নামে গুচ্ছের মামলা হয়েছে। বিচারের জন্য হাসিনাকে ফেরত চায় ঢাকা। চিঠি পাঠানোর সময়ও ইউনূস সাহেব বিলকুল জানতেন, কাগজ আর প্রিন্টারের কালি নষ্টই সার, হাসিনা হাতে আসবে না। খুব সম্ভবত রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢুকে শেখ হাসিনার তত্ত্বতালাশ নেওয়ার সময় মাহফুজকে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীমউদ্দীন জানিয়েছেন, “আফারে ফিরায়া আননের কথা ভুইলা যাও মিঁয়া।”
শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত দেবে না, এটা জানার পরেও ‘মাইন্ড’ আওলায়ে গিয়ে ‘মাস্টারমাইন্ড’ মাহফুজ যে আলফাল কথা মুখ থেকে ছুটিয়ে ইউনূসকে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলেন নাই, এর জন্য বরং মাহফুজের একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। মানতে হবে অল্প সময়ের মধ্যেই মাহফুজ ‘পলিটিক্যাল ম্যচিউরিটি’ লাভ করে ‘মাস্টারবেট’ করা বন্ধ করেছে। অথচ দিন দশেক আগেও ভারত ভেঙে সাগর থেকে পাহাড় অখন্ড বাংলাদেশ গড়ার পোস্ট দিয়েছিলেন আগুনের গোলার মতো এই বিপ্লবী পোলা। সেই পোস্ট অবশ্য বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেন নি মাহফুজ। ডিলিট করে সরকারি চেয়ার বাঁচাতে হয়েছে তাঁকে। মিনমিন না করে ইউনূসের উচিত ছিল মাহফুজের কানের গোড়ায় একটা চটকানা মেরে বোঝানো, সরকারটা ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিএসসির দেওয়াল না যে, যা খুশি তাই লিখে দেওয়া যায়।
চাল-আলু-পেঁয়াজ পাবা, হাসিনারে না
শেখ হাসিনাকে উৎখাতের পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। তাতে অবশ্য ভারত থেকে বাংলাদেশে চাল-আলু-পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ নেই। চারদিন আগেই চট্টগ্রাম বন্দরে ভারত থেকে পাঠানো ২৪ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন চাল খালাস হয়েছে। এটা প্রথম চালানের একটা অংশ মাত্র। ধাপে ধাপে আরও চাল বাংলাদেশে যাবে। হাতেপায়ে ধরলে বাংলাদেশকে চাল-ডাল-তেল-নুন না দিয়ে পারবে না ভারত। কিন্তু হাসিনাকে দিবে না।
তুমি রিয়েলিটি মাইনা নাও, না মাইনা উপায় নাই
নিঃসন্দেহে ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে বড় গাফিলতি ছিল। শেখ হাসিনা ভারতের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন। নয়াদিল্লি তাঁর সবথেকে বিশ্বস্ত মিত্রকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে নি, এটা সাউথ ব্লকের বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা। বন্ধুকে সদুপদেশ দেওয়া বন্ধুর কর্তব্য। ভারতের নীতি নির্ধারকরা কি শেখ হাসিনাকে সদুপদেশ দেন নি, নাকি হাসিনা ভারতের সদুপদেশ কানেই তোলেন নি? শেখ হাসিনা যে’ভাবে দেশ চালাচ্ছিলেন, তাতে চোখবন্ধ করে সায় না দিয়ে দিল্লির উচিত ছিল তাঁকে সময় থাকতে সংযত করা। শেখ হাসিনার পতন যে অনিবার্য, এটা একবারে অন্তিম মুহূর্তের আগে বুঝতেই পারে নি সাউথ ব্লক। এটাকে ভারতের কূটনীতিক ও ফরেন ইন্টেলিজেন্সের গোয়েন্দাদের একটা বিশাল ব্যর্থতা বলে মানতেই হবে।
শেখ হাসিনার দোষ-গুন যাই থাকুক, ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি ভারতের স্বার্থ রক্ষায় কার্পণ্য করেন নি। তাই শেখ হাসিনার প্রাণ এমনকি রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা ভারতের কূটনৈতিক দায়। যে কোনও বৃহৎ শক্তিই বিপদের দিনে মিত্রদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় না। ভারতও নেবে না। ৫ অগাস্ট বিপন্ন শেখ হাসিনাকে সসম্মানে আশ্রয় না দিয়ে যেমন ভারতের সামনে দ্বিতীয় কোনও রাস্তা খোলা ছিল না, তেমনি শেখ হাসিনাকে সসম্মানে রক্ষা করা ছাড়াও ভারতের সামনে আর কোনও রাস্তা নেই। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামি লিগ যাতে প্রাসঙ্গিকতা না হারায়, ফের একবার এই দায়িত্বও ভবিষ্যতে ভারতের কূটনীতিকদের নিতে হতে পারে। বাংলাদেশে এখন যারা ক্ষমতায় আছে এবং ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা সবাই জানে, এই রিয়েলিটি মাইন্যা নিয়া ভারতের সঙ্গে ঘর করা ছাড়া তাদের সামনেও আর কোনও রাস্তা নাই।
Feature graphic is representational and designed by NNDC.