সর্ষের মধ্যেই ভূত! আশঙ্কায় শ্রীরামপুর, দমদম ও কলকাতা উত্তরের তৃণমূল প্রার্থীরা

সর্ষের মধ্যেই ভূত! আশঙ্কায় শ্রীরামপুর, দমদম ও কলকাতা উত্তরের তৃণমূল প্রার্থীরা


দুঁদে আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেজাজ লন্ডনের আবহাওয়ার মতোই আনপ্রেডিক্টেবল। এবারের প্রচারপর্বে বারেবারে মেজাজ হারিয়েছেন কল্যাণ। দলের বিধায়ক অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিককে পর্যন্ত মুখ ঝামটা দিয়ে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে তৃণমূলের ভেতরে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। অপমানিত কাঞ্চন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বলে শোনা গেছে। দলের বুড়োরা এ যাত্রায় টিকিট পান, তা নাকি চান নি অভিষেক। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স সত্তর পেরোয় নি। তারপরেও চক্ষুশূল কল্যাণকে প্রবীণের দলে ঠেলে তাঁর মনোনয়ন পাওয়ার পথে জল ঢালতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেন নি তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। যদিও ভাইপোর আপত্তি ধোপে টেকে নি, দুঃসময়ের সাথীকে এবার‌ও টিকিট দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রচারপর্বে কল্যাণের ঘন ঘন মেজাজ হারানোর কারণ নিয়ে শ্রীরামপুরের বাজারে অনেক কথাই শোনা যাচ্ছে। তিনবারের সাংসদ এবার নাকি নাকে অন্যরকম গন্ধ পেয়েছেন। শ্রীরামপুরে বিজেপির হয়ে কল্যাণের মোকাবিলায় এবার মাঠে তাঁর‌ই প্রাক্তন জামাতা কবীরশঙ্কর বসু। প্রাক্তন হলেও জামাই তো; লড়তে কার ভাল লাগে! প্রচারে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছেন সিপিএমের তরুণ মুখ দীপ্সিতা ধর‌ও। তবে বাইরের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে কল্যাণ নাকি বেশি টেনশনে ঘরের লোকেদের নিয়েই। চতুর্থ বারের জন্য সংসদে যাওয়ার পথে অন্তর্ঘাতকেই সবথেকে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোট মিটে গেছে কিন্তু দুশ্চিন্তা দূর হয় নি। ৪ জুন ইভিএম না খোলা পর্যন্ত কল্যাণের উসখুস দূর হবে না।

সুদীপ, সৌগত ও কল্যাণ- দলের তিন‌ হেভিওয়েট নেতার হয়ে প্রচারেই নামেন নি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এন‌এনডিসি গ্রাফিক্স

কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাগ্যে যাই লেখা থাকুক, তা ইভিএম বন্দি হয়ে গেছে। কিন্তু অভিষেকের চক্ষুশূল তৃণমূলের অপর দুই প্রবীণ নেতার ভাগ্য পরীক্ষা শনিবার (১ জুন) শেষ দফায়। উত্তর কলকাতায় ৭৫ বছরের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে তৃণমূলের ভেতরে জল অনেক দূর পর্যন্ত ঘোলা হয়েছে। সুদীপ যাতে টিকিট না পান, তার জন্য ভোটের এক বছর আগে থেকেই নাকি হোম‌ওয়ার্ক করেছে অভিষেক লবি। অভিষেক যখন তৃণমূলের ভেতরে অতি সক্রিয়, তখন সুদীপ নিজেও হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নভেম্বরে স্বপনকুমারের মোহন সিরিজের ভাষায় তৃণমূলের ভেতরে ”কোথা থেকে কি হইয়া গেল বোঝা গেল না” স্টাইলে মমতা স্বমূর্তিতে অবতীর্ণ হতেই বুড়োরা আবার বুকে বল ফিরে পেলেন। মুখ্যমন্ত্রী তো নেতাজি ইনডোরের মঞ্চ থেকেই ৭৬ বছরের সৌগত রায়কে অভয়বাণী দিলেন-“বয়স হয়েছে বয়স হয়েছে করবেন না তো সৌগতদা। বয়স আবার কীসের? বয়স তো মনের।”

কুণাল ঘোষকে দিয়ে বিদ্রোহের নাটক সাজিয়েও পিসিকে টলাতে পারেন নি ভাইপো। শেষ পর্যন্ত উত্তর কলকাতায় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দমদমে সৌগত রায় ও শ্রীরামপুরে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোনয়ন আটাকাতে পারেন নি অভিষেক। বৃহস্পতিবার শেষ দফার ভোট প্রচার শেষ হয়েছে। শ্রীরামপুরের মতোই উত্তর কলকাতা ও দমদমের মাটিও মাড়ান নি তৃণমূলের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’। অভিমানে শুধু কি মাটি না মাড়িয়েই ‍ক্ষান্ত অভিষেক? নাকি গোপন রাগে আরও কিছু মিশনেও যুক্ত ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ তথা তৃণমূল প্রার্থী। কলকাতা উত্তর নিয়ে শুধু সুদীপ একা নন মমতা নিজেও টেনশনে।

উত্তর কলকাতায় বিজেপির প্রার্থী তাপস রায়। সুদীপকে হারাতে তৃণমূলের একটি অংশ গোপনে তাপসের সাথে, বাজারে গুঞ্জন এমন‌ই। ছবি: সংগৃহীত

তৃণমূলে থাকতে তাপস রায় ছিলেন অভিষেকের শিবিরে। তাঁকে টিকিট পাইয়ে দিতে ব্যর্থ অভিষেক। ক্ষোভে দল ছেড়ে তাপস বিজেপিতে যোগ দিয়েই ভোটের লড়াইয়ে সুদীপের মুখোমুখি। উত্তর কলকাতায় তৃণমূলের যে অংশটি সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধী, তাপস রায় তাঁদের সহযোগিতা পাচ্ছেন বলে বাজারে গুঞ্জন। অভিষেক ঘনিষ্ঠ কুণাল উপরে উপরে সুদীপের সঙ্গে হাত মেলালেও তাঁকে নাকি কড়া নজরে রেখেছেন মমতা। উত্তর কলকাতা নিয়ে তৃণমূলের ভেতরে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা এতটাই প্রবল যে কালীঘাট থেকে নির্দেশ এসেছে, যে কোনও মূল্যে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয় চাই। কিন্তু সুদীপকে জেতাতে কালীঘাট যতটা উদগ্রীব ততটাই নিস্পৃহ ক্যামাক স্ট্রিট।

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সৌগত রায়‌ও মনোনয়ন লাভের আশা প্রায় ত্যাগ করেছিলেন। উত্তর কলকাতা ও দমদমকে তৃণমূলের সিওর সিটগুলির মধ্যে অন্যতম মনে করে রাজনৈতিক মহল। তাই এই দুই আসনের প্রার্থী নিয়ে তৃণমূলের ভেতরে প্রবল প্রতিযোগিতা। দুটিতেই অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে হেরে বসে আছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই রাগেই কি শ্রীরামপুরের মতো উত্তর কলকাতা ও দমদমে প্রচারেই গেলেন না অভিষেক? দলের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ হয়ে দলের দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর প্রচারে না যাওয়াটা দলের সঙ্গে অসহযোগিতারই সমতুল্য। সুদীপ ও সৌগতের সঙ্গে কি শুধু অসহযোগিতা করেই থেমে আছেন অভিষেক? শনিবার অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা শুধু সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়‌ই করছেন না, দমদমে সৌগত রায়‌ও সর্ষের মধ্যে ভূত নিয়ে চিন্তিত।

Feature graphic is representational and created by NNDC.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *