ইনফোয়ানা ফিচার: একজনের আবির্ভাব বৈশাখের ২৫ তারিখ। আরেক জন এসেছিলেন জ্যৈষ্ঠের এগারোতে। কিন্তু বয়সের ব্যবধান বিরাট! ৩৮ বছরের। যদিও বাংলা সাহিত্যের এই দুই দিকপালের মধ্যে সম্পর্কে কোনও দূরত্বই ছিল না। রবীন্দ্র-নজরুল; মাঝে ছোট্ট একটা হাইফেন মাত্র। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব জ্ঞানে মাথায় রাখতেন নজরুল। নবীন নজরুলের কবিতা পাঠ করা মাত্রই রত্ন চিনতে ভুল করেন নি জহুরি রবীন্দ্রনাথ।
যে মূর্খরা বিদ্রোহী কবিকে বড় করতে গিয়ে বিশ্বকবিকে ছোট করে, তারা জানে না, ১৯২৩ সালেই তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক কাজি নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তখন নজরুলের বয়স মাত্র চব্বিশ, গুরুদেবের বাষোট্টি। ১৯২১ সালের ঘটনা- বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভায় রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করেই মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছিলেন বাইশ বছরের নজরুল। নজরুলকে হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে ষাটের রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “নিচে নয়, এই সভায় আমার পাশেই তোমার স্থান নজরুল।” প্রবাদই তো আছে- জহুরি জহর চেনেন।
৭৭ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন বাঙালির বিদ্রোহী কবি। কিন্তু বাকরহিত কবির সে বাঁচাকে তো বাঁচা বলা চলে না। ১৯৪১ সালের ৭-ই অগাস্ট রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসান। গুরু বিয়োগে শোকার্ত নজরুল গান বাঁধলেন- “ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে…”। লিখলেন, বিরাট কবিতা- ‘রবিহারা’। নজরুল গবেষকদের কেউ কেউ দাবি করেন, বাইশে শ্রাবণের দুপুরে আকাশবাণীতে ‘রবিহারা’ আবৃত্তি করতে করতেই প্রথম অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন কবি।
কারও মতে, এক বছর পর ১৯৪২-এর ৯ জুলাই, কলকাতা বেতারে গান রেকর্ডিংয়ের সময় প্রথম রোগে আক্রান্ত হন কাজী নজরুল। আর সেরে উঠলেন না বিদ্রোহের কবি, বিপ্লবের কবি। তখন নজরুলের বয়স মাত্র চুয়াল্লিশ। সাতচল্লিশে দেশভাগ- বাঙালির জীবনে নামল মহাবিপর্যয়। সেই ঘোর অন্ধকারে রবীন্দ্রনাথ লোকান্তরে। স্মৃতিহারা নজরুল নির্বাক- জগতে থেকেও তিনি নেই। বিধাতারই বোধহয় ইচ্ছে ছিল না, মর্মান্তিক সেই যন্ত্রণা সহ্য করুন স্বজাতি-অন্তপ্রাণ দুই কিংবদন্তি কবি।
সুর ও সঙ্গীত যেনো নজরুলের সহজাত কবচকুন্ডল। গলায় গান নিয়েই জন্মেছিলেন তিনি। পেটের দায়ে কৈশোরেই পড়া ছেড়ে লেটোর দলে গান বেঁধেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। মেধাবী ছাত্র। কিন্তু ম্যাট্রিকুলেশন না দিয়েই নাম লিখিয়েছিলেন পল্টনে। উপরে ফৌজি হলেও নজরুলের ভেতরের কবিত্ব কখনও মরে নি।
ক্ষণজন্মা বলতে যা বোঝায়, দুখু মিয়া ছিলেন তাই। বাংলার সাহিত্যাকাশে ধূমকেতুর মতোই নজরুলের উত্থান। দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতোই রূপ। বিপরীতমুখী অজস্র সত্ত্বার অদ্ভুত সমাগম তাঁর চরিত্রে। প্রায় চার হাজার গান লিখেছেন। অধিকাংশ গানে সুর দিয়েছেন নিজেই। ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’-এর অনুবাদক মুসলমান নজরুল শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন ২৪৭টি।
কাজীর কৃষ্ণ ভজনগুলিও অতুলনীয়। তাঁকে বলা হয় বিদ্রোহের কবি। কিন্তু ভক্তিতেও তিনি কম কীসে! একমাত্র নজরুলই লিখতে পারেন- খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে। / প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে।।…
কস্তুরী মৃগ যেমন আপন সুবাসে চঞ্চল, তেমনি নিজের প্রতিভার দহনে অস্থির ছিলেন কাজী নজরুল। নজরুল বেঁচেছিলেন ৭৭ বছর। কিন্তু তাঁর সৃজনশীল জীবনের আয়ু মাত্র বাইশ বছর। দরিদ্র পরিবারে জন্ম। যতদিন সজ্ঞানে সাহিত্য ও সঙ্গীতের সেবা করেছেন, ততদিন সংসারে একটুও সুখের মুখ দেখেন নি কবি। অর্থকষ্ট নজরুলের জীবনীশক্তি শুষে নিতে পারে নি কিন্তু পুত্রশোক তাঁকে পাষাণ করে দিয়েছিল।
বড় পুত্রের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মহম্মদ। জন্মের কয়েক মাস পরেই সে মারা যায়। সে শোক সামলে নিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি। কিন্তু চার বছর বয়সে প্রাণাধিক প্রিয় বুলবুল যখন উড়ে গেল, সেই আঘাত আর কখনও সামলে উঠতে পারেন নি কাজী। সহধর্মিণী প্রমীলা পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হলেন ১৯৩৯-য়ে। তার তিন বছর পর নিজেই চিরতরে নীরব হয়ে গেলেন কবি। নীরব হওয়ার আগেই নজরুল লিখে গেছেন- ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি?/ভোরের হাওয়ায় কান্না পাওয়ায় তব ম্লান ছবি।’ কবি কি জানতেন তাঁর পরিণতি?
Video and Feature credit- Infoyana YouTube channel.