বিশেষ প্রতিবেদন: তৃণমূলের আমলে বাংলায় নারীর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন চরমে উঠেছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। সন্দেশখালিতে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মহিলাদের উপরে সংগঠিত যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ঘিরে এখন উত্তাল গোটা রাজ্য। শেখ শাহজাহানের বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার সন্দেশখালির মহিলারা যখন সবে মুখ খুলতে শুরু করেছেন, তখন রাজ্যের সংশোধনাগারগুলিতে মহিলা কয়েদিদের অবস্থা নিয়েও ভয়ঙ্কর রিপোর্ট জমা পড়েছে আদালতে। রাজ্যের বিভিন্ন সংশোধনাগারে ২০২৩-এর পয়লা এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১৯৬টি শিশুর জন্ম হয়েছে বলে কলকাতা হাইকোর্টে রিপোর্ট জমা করেছেন আদালত বান্ধব তাপস ভঞ্জ। সংশোধনাগারগুলিতে থাকা মহিলা বন্দিরা এই শিশুদের জন্ম দিয়েছেন।
ঘটনাটি আর রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। কীভাবে সংশোধনাগারের ভেতরে মহিলা কয়েদিরা অন্তঃসত্ত্বা হলেন, এই প্রশ্ন তুলেছে দেশের শীর্ষ আদালত। বিষয়টি কানে যেতেই কলকাতা হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলাটি বৃহস্পতিবার স্বতঃপ্রণোদিতভাবে নিজেদের হাতে তুলে নেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিমা কোহলি ও বিচারপতি আসানুদ্দিন আমানুল্লাহ। শুক্রবার ছিল এই মামলার শুনানি। কারাগারগুলিতে মহিলা কয়েদিরা কী অবস্থায় আছেন, তা জানাতে এ’দিন দেশের সব রাজ্যের সরকারের প্রতি নির্দেশ জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। বাংলার সংশোধনাগারগুলিতে মহিলা বন্দীদের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঘটনায় বিচলিত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা একটি কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছেন। এই কমিটির সদস্যরা রাজ্যে রাজ্যে গিয়ে জেলখানাগুলিতে ঢুকে মহিলা কয়েদিদের পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখে রিপোর্ট তৈরি করে সুপ্রিম কোর্টে জমা দেবেন।
দেশের কারাগারগুলির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে রাজ্যে রাজ্যে ‘অ্যামিকাস কিউরে’ বা আদালত বান্ধব নিয়োগের নির্দেশ আগেই দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে পশ্চিমবঙ্গের সংশোধনাগারগুলির জন্য আইনজীবী তাপস ভঞ্জকে আদালত বান্ধব হিসেবে নিযুক্ত করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। জেলখানায় বন্দীরা কেমন আছে। সরকারের দেওয়া যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা তারা ঠিকমতো পাচ্ছে কিনা, এইসব নজরে রাখাই আদালত বান্ধবের কাজ। সম্প্রতি আলিপুর মহিলা জেলে এক বন্দি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের সব সংশোধনাগারে মহিলা কয়েদিদের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়ে চোখ কপালে ওঠে আদালত বান্ধব তাপস ভঞ্জের। অনুসন্ধান করে তিনি জানতে পারেন, গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত রাজ্যের সংশোধনাগারগুলিতে ১৯৬টি শিশুর জন্ম হয়েছে।
সমস্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর প্রতিকার চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আদালত বান্ধব। হাইকোর্টে তাপস ভঞ্জ জানান, “রাজ্যের সংশোধনাগারগুলির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়ে যে ছবি উঠে এসেছে সেটা উদ্বেগজনক। সংশোধনাগারে থাকাকালীন নারী বন্দিরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছেন। ১৯৬ জন শিশু মায়ের সঙ্গে সংশোধনাগারে রয়েছে। সংখ্যাটা গত বছর পয়লা এপ্রিল পর্যন্ত। ইতিমধ্যে ওই সংখ্যা হয়তো বেড়েছে বলেই আশঙ্কা করা যায়।” জেলখানার মহিলা ওয়ার্ডে কোনও পুরুষের এমনকি পুরুষ কর্মীদেরও প্রবেশ করার কথা নয়। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে মহিলা বন্দিরা অন্তঃসত্ত্বা হলেন, এই প্রশ্ন উঠেছে।
রাজ্যের সংশোধনাগারগুলিতে মহিলা কয়েদিদের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর নানা সাফাই দেওয়া শুরু করেছে কারা দফতর। সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের আইনজীবী দাবি করেছেন, অধিকাংশ মহিলা বন্দিই বাইরে থেকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় জেলে এসেছেন। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের সামনে রাজ্যের কারামন্ত্রী অখিল গিরি যা বলেছেন কিম্বা হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের সামনে রাজ্য সরকারের আইনজীবীরা যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে অসঙ্গতির ছাপ স্পষ্ট। কোনও কোনও মহিলা জেলে আসার আগেই অন্তঃসত্ত্বা হলেও জেলে থাকাকালীনও যে কেউ কেউ অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন, তা অস্বীকার করতে পারছে না কারা দফতর। আসলে কতজন মহিলা কয়েদি জেলে আসার আগেই অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন আর কতজন জেলে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন, সেই জবাব কারা কর্তৃপক্ষের কাছেও নেই। যে মহিলা বন্দিরা জেলের ভেতরেই অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন, কারা তাঁদের অন্তঃসত্ত্বা করল, সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের পর তা অনুসন্ধান করে দেখা হবে বলে আশা করছেন রাজ্যের মানবাধিকারকর্মীরা। বিষয়টিকে জেলখানায় ধর্ষণ হিসেবেই দেখছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
রাজ্যের সংশোধনাগারগুলির ভেতরের পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ বহু দিনের। জেলের ভেতরে নেশাভাঙের আসর বসে বলে অভিযোগ। এমনকি পয়সা দিলে অনেক জেলখানায় পুরুষ কয়েদিদের জন্য নারী সংসর্গও জুটে যায়। এবার প্রায় দুশো মহিলা কয়েদি এক বছরে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঘটনা জানাজানি হতেই বিরোধীরা কটাক্ষ করে বলছেন, নিজের ঘর থেকে জেলখানা- একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর জামানায় বাংলার মহিলারা আর কোথাও সুরক্ষিত নন।
Feature image is representational.