সন্দেশখালিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জাওয়ানদের সংযম উত্তেজিত জনতার হাতে ইডির আধিকারিকদের প্রাণহানির কারণ হতে পারত। লিখলেননির্বাণ রায়-
শুক্রবার সন্দেশখালিতে ইডির আধিকারিকদের নিরাপত্তায় থাকা সিআরপিএফ জাওয়ানেরা গুলি চালিয়ে দিলে আজ বাংলার পরিস্থিতি কী হত, চিন্তা করুন। সারা রাজ্যে দলের কর্মীদের পথে নামিয়ে দিয়ে এতক্ষণে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে ধর্নায় বসে যেতেন মুখ্যমন্ত্রী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে হুলিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার এই কৌশল একুশে সফল হয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনে চতুর্থ দফা ভোট গ্রহণের দিন শীতলকুচিতে বুথের বাইরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে চার গ্রামবাসীর মৃত্যুর পর তৃণমূলের ক্ষমতায় ফেরার রাস্তা আরও মসৃণ হয়ে যায়। এই রকম একটা পরিস্থিতি যাতে তৈরি হয়, সেই লক্ষ্যে ভোট প্রচারের সময় নিয়ম করে মঞ্চ থেকে ইন্ধন দিয়ে গেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। ভোটের চতুর্থ দফায় এসে তাঁর মনোস্কামনা পূর্ণ হয়। যে ক’জন সংখ্যালঘু অন্য প্রতীকে ভোট দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেছিলেন, শীতলকুচি কান্ডের পর তাঁরাও চোখ বন্ধ করে জোড়াফুলে বোতাম টেপেন।
শুক্রবার সন্দেশখালিতে আরও একটা শীতলকুচি ঘটতেই পারত অথবা আরও একটা গার্ডেনরিচ। ইডির গুটি কয়েক তদন্তকারী আধিকারিকের নিরাপত্তায় কয়েকজন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জাওয়ান। ইডির গাড়ি ঘিরে হাজার হাজার মানুষ। সামনে মহিলারা। দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করতে গিয়ে ১৯৮৪-র ১৮ মার্চ গার্ডেনরিচে এই রকম পরিস্থিতিতেই ব্যক্তিগত দেহরক্ষী সহ খুন হয়েছিলেন ডিসি পোর্ট বিনোদ মেহতা। ইডির আধিকারিকদের জীবনরক্ষায় যে কোনও ধরণের পদক্ষেপ করার অধিকার কেন্দ্রীয় বাহিনীর জাওয়ানদের ছিল। তাঁদের সংযম উত্তেজিত জনতার হাতে অফিসারদের প্রাণহানির কারণ হতে পারত। ইডির আহত আধিকারিকদের অবস্থা দেখেই বোঝা যায়, তাঁদের বড় ফাঁড়া কেটেছে।
রাজ্যে আইনের শাসন রক্ষা করা যাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব, তাঁর দুরভিসন্ধি শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের আতঙ্কিত করার জন্য যথেষ্ট। তিনি ভালোই জানেন, সন্দেশখালিতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দিক থেকে শক্ত পদক্ষেপের কারণে কারও জীবনহানি ঘটলে তিনি খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারবেন। শীতলকুচি তাঁকে সেই রাস্তা দেখিয়েছে। আবার দুয়ারে নির্বাচন। লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। এটাই তো উপযুক্ত সময়, সংখ্যালঘুদের ভোট কাচিয়ে ঘরে তোলার। শুধু সন্দেশখালিই নয়, আশেপাশের কোনও ব্লকে রাজ্য পুলিশের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। শুধু সুন্দরবনই নয়, রাজ্যের যে কোনও প্রান্তে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় আইনশৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দিলে পুলিশকে প্রথমে নিষ্ক্রিয় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এটা পশ্চিমবঙ্গে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কোনও কেন্দ্রীয় এজেন্সি তদন্তের কাজে বাংলায় এলে রাজ্য প্রশাসন তাদের সহযোগিতা করে না। পুলিশের সাহায্য চাইলে উল্টে অভিযানের গোপন খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। একদম উপর মহল থেকেই পুলিশকে এমন নির্দেশ দেওয়া আছে বলে কারও কারও সন্দেহ।
এবার থেকে মনে হয়, কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্য নিয়ে ইডি-সিবিআইয়ের মতো শক্তিশালী এজেন্সি শাহজাহান শেখদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে এলেই সন্দেশখালি মডেল প্রয়োগ করা হবে। এটাকে শাহজাহানদের প্রতি সরকারের তরফে এক ধরণের ‘ইনডেমনিটি’ ছাড়া আর কী বলা যায়, বলুন! শাহজাহান শেখদের মতো সংখ্যালঘু নেতাদের উদ্দেশে মমতার বার্তাটা খুব পরিষ্কার- তোমরা তোমাদের সম্প্রদায়ের ভোটটা দলের বাক্সে ঢালতে থাকো, দল তোমাদের যে কোনও মূল্যে রক্ষা করবে।
মার্চ মাসের দশ তারিখের মধ্যেই লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে শক্ত কোনও পদক্ষেপ আশা করা বৃথা। তবে বিচার বিভাগ ভরসা। শাহজাহান শেখদের আইনের আওতায় আনার পথে ভবিষ্যতে যাতে সন্দেশখালির মতো ঘটনার সম্মুখীন না হতে হয়, সেই লক্ষ্যে অবিলম্বে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হওয়া উচিত ইডি-সিবিআইয়ের।
Feature image- collected.