যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হস্টেলে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তে নেমে পুলিশ র্যাগিংয়ের প্রমাণ পেয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। পুলিশ সূত্রে যে তথ্য সংবাদ মাধ্যমের কানে আসছে, তাকে নিছক র্যাগিং বললে ভুল হবে। গত ৯ অগাস্ট প্রায় মধ্য রাতে মেইন হস্টেলের এ ব্লকের তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল নদীয়ার হাঁসখালির বগুলা থেকে আসা সতেরো বছরের ছেলেটি। ঘটনার সময় ছেলেটির শরীরে কোনও জামাকাপড় ছিল না। পুলিশ জানতে পেরেছে, ঘটনার রাতে ছেলেটিকে বিবস্ত্র করেছিল সিনিয়ররা। হস্টেলের ৭০ নম্বর ঘরে তাকে বিবস্ত্র করা হয়েছিল। এইখানেই থেমে থাকে নি যাদবপুরের মেধাবী পিশাচেরা। তারা ছেলেটিকে নগ্ন অবস্থায় হস্টেলের বারান্দায় হাঁটতে বাধ্য করেছিল বলেও জানতে পেরেছে পুলিশ।
এইটুকুই যে কোনও সুস্থ, সংবেদনশীল, বিবেকবান মানুষের বমনোদ্রেকের জন্য যথেষ্ট। যারা হামেশাই বিপ্লব স্পন্দিত বুকে চে গুয়েভারার ছবি ছাপানো টিশার্ট পরে স্লোগানে স্লোগানে রাস্তা মুখরিত করে, তারা নিজেদের ডেরায় কতটা নৃশংস ও অমানবিক হতে পারে, নদীয়ার বাচ্চা ছেলেটি মারা না গেলে আমরা জানতেই পারতাম না। তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে জড়িত অনেকেই এই বিপ্লবী পুঙ্গবদের গুপ্ত কান্ডকারখানার কথা নিশ্চিত জানতেন, জেনেও চুপ ছিলেন। হস্টেল টর্চার সেল হয়ে উঠেছিল আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছুই জানত না, এই কথা বিশ্বাস করা শক্ত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকেরা ছেলেটির মৃত্যুতে আজ কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করছেন, হস্টেলে নিযার্তনের বিরুদ্ধে তাঁরা আগেই আওয়াজ তুললে মর্মান্তিক ঘটনাটি হয়তো রোধ করা যেত। কবিগুরু লিখেছেন, “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’ সহনাগরিদের সম্মিলিত ঘৃণা থেকে এই শিক্ষকেরাও রেহাই পাবেন না।
যাদের হৃদয়ে দয়া-দায়বদ্ধতা কোনওটাই নেই, তাদের মেধা-পান্ডিত্য ধুয়ে সমাজ জল খাবে? ছেলেটিকে সেই রাতে যখন ১২-১৩জন মিলে জোর করে নগ্ন করছিল, তার মনের অবস্থা কী হয়েছিল, ভাবলেই হৃদয় মোচড় দিয়ে ওঠে। হয়তো হাতে পায়ে ধরেছিল দাদাদের। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল ভয়ে-আতঙ্কে-লজ্জায়। অসহায় কনিষ্ঠের করুণ মুখের দিকে তাকিয়েও যাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে অনুকম্পা জাগে না, তারা এখনও মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয় কোন মুখে? জেলখানায় শুনেছি নতুন কয়েদীরা পুরোনো কয়েদীদের হাতে যৌন নির্যাতনের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। যাদবপুরের হস্টেল বীভৎসতায় জেলখানার থেকে কম কীসে? সহআবাসিককে উলঙ্গ করে যারা পৈশাচিক আনন্দ লাভে অভ্যস্ত, তারা নাকি দিন বদলের স্বপ্ন দেখে!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হস্টেলে নদীয়ার ছেলেটির সঙ্গে যা যা ঘটেছে, তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ছেলেটির উপরে যেটা হয়েছে সেটা সাধারণ ‘র্যাগিং’ নয় এমনকি মৌখিক যৌন নির্যাতনও নয়। একে সংগঠিত যৌন হিংসা বা ‘অর্গানাইজড সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স’ ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। যাদবপুরের ক্যাম্পাস সংস্কৃতি এই ধরণের হিংসায় পড়ুয়াদের একটা বড় অংশকে প্ররোচিত করছে বলেই হস্টেলে নবাগতদের নগ্ন করা সহজাত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যাদবপুরে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ তিনজন প্রাক্তনী সহ ১২জন আবাসিককে গ্রেফতার করেছে। একজন বাদ দিয়ে বাকিরা এই রাজ্যের এবং সবাই সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। পড়ালেখা শিখে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাদের বাপ-মায়ের অবলম্বন হয়ে ওঠার কথা, তাদের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাওয়ার পথে। যে সংস্কৃতি, যে যাপন, যে রাজনীতি তারুণ্যের শুরুতেই এতগুলি জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিল, সেই সংস্কৃতিকে নির্মূল করা সবার আগে প্রয়োজন। একটি ছেলেকে বিবস্ত্র করতে গিয়ে এই নষ্টের দল নিজেদের সাধের বিপ্লবের পীঠস্থানকেই নগ্ন করে ছাড়ল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলঙ্ক মোচনে একটা ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ না হলেই নয়।
Feature graphic is representational.