নদীয়ার হাঁসখালির বগুলা থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল স্বপ্নদীপ কুন্ডু। ফিরল লাশ হয়ে। উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান শাখার ছাত্র ছিল স্বপ্নদীপ। বাংলা ভাল লাগত বলে স্নাতকে এসে পথ বদল করেছিল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্সে ভর্তি হয়েছিল সে। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাদবপুরের নাম-ডাকই আলাদা। গ্রামের মেধাবী ছেলেমেয়েদের কাছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারাটা একটা স্বপ্ন। সেখানে সন্তানদের পড়তে পাঠানো বাবা-মায়ের জন্যেও গর্বের। স্বপ্নদীপেরও নিশ্চয় অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সে আজ মৃত। স্বপ্নদীপ তো মরে জীবনের সব শর্ত থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে। কিন্তু তার বাপ-মায়ের জ্বালা জুড়োবে কীসে?
মৃত্যু জীবনের সঙ্গে ছায়ার মতোই সদা চলমান। স্বাভাবিক মৃত্যু অকালে হলেও নিয়তির দিকে আঙুল তুলে শোকে প্রলেপ দেওয়ার একটা সুযোগ থাকে। কিন্তু স্বপ্নদীপ কুন্ডুর মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয়, এমনকি নিছক দুর্ঘটনাবশতও নয়, তা স্পষ্টতই প্রতীয়মান। স্বপ্নদীপ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হস্টেলে জায়গা পায় নি। এক বন্ধুর ‘গেস্ট’ হিসেবে হস্টেলে থাকছিল। বুধবার রাত ১১ টা ৪৫ মিনিট নাগাদ মেইন হস্টেলের ‘এ’ ব্লকের তৃতীয় তলার ‘ব্যালকনি’ থেকে পড়ে যায় স্বপ্নদীপ। বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটেয় হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই ছেলেটা মাকে ফোন করে বলেছিল, “মা, আমি ভাল নেই। আমার খুব ভয় করছে।” স্বপ্নদীপ হস্টেলে মোটেই স্বস্তিতে ছিল না, মায়ের সঙ্গে ছেলের শেষ কথোপকথনেই তা প্রমাণিত।
প্রত্যক্ষ হোক আর পরোক্ষ, ‘র্যাগিং’-ই যে স্বপ্নদীপ কুন্ডুর অকাল মৃত্যুর কারণ, তা আর ধামাচাপা দেওয়ার উপায় নেই। এখন দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং আইনতঃ নিষিদ্ধ। রাজ্যের প্রত্যেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন মেনে ‘অ্যান্টি র্যাগিং সেল’ আছে। স্বপ্নদীপের মৃত্যুর পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হস্টেলের অন্দরমহলের যে’সব খবর বাইরে আসছে, তাতে প্রশ্ন একটাই- প্রগতিশীল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যান্টি র্যাগিং সেল’-এর কাজটা ঠিক কী? ঠিক কোন পরিস্থিতিতে প্রথমবর্ষের একজন ছাত্র প্রায় মধ্যরাতে হস্টেলের তিনতলার ‘ব্যালকনি’ থেকে পড়ে গেল, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব পুলিশের। মানুষের মনে স্বপ্নদীপের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে একাধিক প্রশ্ন। কে বা কারা তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল? নাকি ভয়ে- আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে সে নিজেই ঝাঁপ মেরেছিল? অথবা নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক অবসাদের কারণে আত্মহত্যা করেছে স্বপ্নদীপ? একমাত্র তদন্ত যথাযথ হলেই স্বপ্নদীপের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় বিপ্লবের দুর্জয় ঘাঁটি বলে যাদবপুরের এক শ্রেণীর পড়ুয়ার গর্বের সীমা নেই। এদিকে প্রগতিশীলতার ধ্বজ্জাধারী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হস্টেলের পরিবেশ সু্স্থরুচির পড়ুয়াদের বাসের অনুপযুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা যাচ্ছে, সেটা ছাত্রাবাস নয়, নেশাভাঙের উত্তম ঠেক। বছরের পর বছর ধরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হস্টেল বহিরাগতদের দখলে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এই বহিরাগতরা যাদবপুরের প্রাক্তনী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট তাদের কবেই চুকেবুকে গেছে। কিন্তু তারপরেও কোন অধিকারে হস্টেলে পড়ে রয়েছে তারা? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন ছাত্রাবাস প্রাক্তনী মুক্ত করতে ব্যর্থ? এই প্রাক্তনীরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় হস্টেলে গোলমাল পাকানোয় অভ্যস্ত বলে স্বপ্নদীপের মৃত্যুর পর মুখ খুলেছে কোনও কোনও পড়ুয়া।
‘র্যাগিং’ তো শুধু মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনই নয়; সময় সময় এর মধ্যে যৌন লাঞ্ছনার পরিমাণও যথেষ্টই থাকে। হস্টেলে নবাগত স্বপ্নদীপ কুন্ডুর উপরে কোনও প্রকার যৌন নির্যাতনও হয়ে থাকতে পারে বলে পড়ুয়ামহলে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। হস্টেলের ভেতরে তার উপরে কেউ সমকাম চরিতার্থে চাপ সৃষ্টি করতে পারে, এমন তথ্যও উঠে আসছে। স্বপ্নদীপের বাবা রমাপ্রসাদ কুন্ডুর আক্ষেপ, “ছেলেটা হস্টেলে ভাল ছিল না জানার পরেও কেন সময় থাকতে ফিরিয়ে আনলাম না ওকে!” সন্তানকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়ে আর কোনও বাবামাকে ভবিষ্যতে যেন এমন আক্ষেপ না করতে হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, বিখ্যাত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বিপ্লবের দুর্জয় ঘাঁটি না ভেতরটা আসলে পচা পাঁকে ভর্তি? এই যদি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের সংস্কৃতি হয়, তবে সেই সংস্কৃতি পাল্টানোর সময় এসেছে।
Feature image/graphic is representational.