চন্দ্রযান-৩ এর যা খরচ, হলিউডের অনেক ফিল্মের বাজেট তার চার গুণেরও বেশি!
সায়েন্স ডেস্ক: ব্যর্থতা বিজ্ঞানীদের সবথেকে বড় শিক্ষক। ইসরো- ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন। যতবার ব্যর্থ হয়েছে ততবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইসরো। গুটিকয়েক স্বপ্নদর্শী তরুণ বিজ্ঞানীর সহায়তায় ১৯৬৯ সালে যে চারাটি রোপণ করেছিলেন ডঃ বিক্রম সারাভাই, আজ তা মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণায় মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের সেরা বারোটি মহাকাশ গবেষণা সংস্থার মধ্যে ইসরোর রেটিং ছয়ে। ইসরোর ঘুরে দাঁড়ানোর আরও একটি অভিযান শুরু হল শুক্রবার ( ১৪ জুলাই, ২০২৩) দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটের মাহেন্দ্রক্ষণ থেকে। অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে চন্দ্রযান-৩ এর উৎক্ষেপণ সফল হয়েছে। ৪০ দিন পর পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহের মাটিতে নামার কথা চন্দ্রযান-৩ এর।
২০১৯-এর ২২ জুলাই চন্দ্রযান-২ এর উৎক্ষেপণও সফল হয়েছিল। চাঁদ অভিমুখে ৪৪ দিনের যাত্রাও ছিল নির্বিঘ্ন। কিন্তু ৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সময় গভীর রাতে চাঁদের মাটি ছোঁয়ার তিন মিনিট আগে সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায় ইসরোর বিজ্ঞানীদের। সাথে ১৪০ কোটি দেশবাসীরও। এই জাতীয় অভিযানের সবথেকে ‘চ্যালেঞ্জিং’ কাজটা হচ্ছে বায়ু শূন্য চন্দ্রবক্ষে ‘ল্যান্ডার’-এর সফট ল্যান্ডিং’ করানো। চাঁদের আকাশ থেকে পাখির পালকের মতো চাঁদের মাটিতে নামতে হবে যানটিকে। চাঁদের মাটি ছুঁতে ঠিক যখন তিন মিনিট বাকি, তখন গতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়েছিল ল্যান্ডার বিক্রম। অ্যারোনটিক্যাল সায়েন্সের ভাষায় একে বলা হয় ‘হার্ড ল্যান্ডিং’। হার্ড ল্যান্ডিং-এর জেরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ ও তার গর্ভে থাকা রোভার ‘প্রজ্ঞান’।
চন্দ্রযান-৩ এর খরচ মাত্র ৬১৫ কোটি টাকা!
শেষ লগ্নে এসে সাধনায় সিদ্ধি আসে নি। সেই রাতে বেঙ্গালুরুর ইউআর রাও (ইসরো) স্যাটেলাইট সেন্টারের কন্ট্রোল রুমে চোখের জল ধরে রাখতে পারেন নি ইসরোর তৎকালীন চেয়ারম্যান কে শিবান। সারা ভারত ছিল বিনিদ্র। সবার চোখ ইসরোর লাইভ স্ট্রিমিংয়ে। ইতিহাসের সাক্ষী হতে ইসরোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং। চন্দ্রযানের অন্তিম পরিণতির কথা ভেবে শিবানের চোখ ছলছলে। ১৪০ কোটি ভারতবাসীর হয়ে ইসরো চেয়ারম্যানের পিঠে ভরসার হাত রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ব্যর্থতার রজনীতেই আবার নতুন করে চন্দ্রাভিযানের পরিকল্পনা শুরু ইসরোর। ৪ বছরের প্রস্তুতি শেষে ২০২৩-এর ১৪ জুলাই দুপুরে ‘এলভিএম-৩’ রকেটে চেপে চাঁদের দেশে আবার পাড়ি দিল ৩.৮ টন ওজনের চন্দ্রযান-থ্রি। ব্যয়বহুল মহাকাশ গবেষণাকে রীতিমতো সুলভে পরিণত করে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ইসরো। চন্দ্রযান-৩ এর খরচ ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ৬১৫ কোটি টাকা, হলিউডের অনেক সিনেমার বাজেট এর চার গুণ। এমনকি আজকাল ভারতেও ৬০০ কোটি টাকা খরচ করে ফিল্ম বানানো হচ্ছে।
চন্দ্রযান-২ এর থেকেও কম ব্যয়ে অভিযান
ইসরোর আগের দুই চন্দ্রাভিযানের তুলনায় চন্দ্রযান-৩ এর ব্যয় আরও কম। ল্যান্ডার, রোভার আর প্রোপালশন মডিউল নির্মাণের পেছনে খরচ হয়েছে মাত্র ২৫০ কোটি টাকা। এলভিএম-৩ রকেট (যা বাহুবলী নামে পরিচিত) নির্মাণ এবং রকেট উৎক্ষেপণে খরচ হয়েছে ৩৬৫ কোটি টাকা। চন্দ্রযান-২ মিশনে ব্যয় হয়েছিল ৯৭৮ কোটি টাকা। চন্দ্রযান-২ মিশনের অরবিটার, ল্যান্ডার, রোভার, প্রোপালশন মডিউল, নেভিগেশন ও গ্রাউন্ড সাপোর্ট নেটওয়ার্কে খরচ হয়েছিল মোট ৬০৩ কোটি টাকা। আর এলভিএম-৩ বা জিএসএলভি রকেট নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৩৭৫ কোটি টাকা।
চন্দ্রযান-২ এর অর্বিটার ৩-এও
চন্দ্রযান-৩ অভিযানে নতুন কোনও অরবিটার ব্যবহার করছে না ইসরো। চন্দ্রযান-২ এর অর্বিটার এখনও সচলভাবে চাঁদের কক্ষপথে ঘুরে চলে নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সংকেত পাঠাচ্ছে। চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডারের চাঁদে সফল অবতরণ হলে যান থেকে বেরিয়ে আসার পর রোভার প্রজ্ঞানের সঙ্গে গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের যোগাযোগের কাজটা চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার দিয়েই চালিয়ে নেবেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। চন্দ্রযান-৩ মিশন সফল হলে ভারত হবে পৃথিবীর চতুর্থ দেশ, যাদের তৈরি করা ‘রোভার’ চাঁদের মাটিতে চলেছে।
২০১৯-এর ৬ সেপ্টেম্বর চন্দ্রযান-২ আছড়ে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায় চাঁদের বুকে। সেই বছরের ডিসেম্বরেই তৃতীয় অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টারে। ঠিক কোন ভুলের কারণে চাঁদে অবতরণের তিন মিনিট আগে ল্যান্ডার বিক্রম হার্ড ল্যান্ডিং করে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেল, খুঁজে বের করেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। করোনা মহামারি প্রস্তুতিতে বিলম্ব না ঘটালে আরও আগেই চন্দ্রযান-৩ কে চাঁদের দেশে পাঠাতে পারত ভারত।
Feature image credit- ISRO.