মোদীর জাঁকজমকপূর্ণ আমেরিকা সফর প্রমাণ করল, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যতটুকু অবনতি হয়েছে তা দ্রুত সারিয়ে ফেলতে কতটা মরীয়া বাইডেন প্রশাসন।আরও যা লিখলেন উত্তম দেব-
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বছর ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকা সফরে গেলে হোয়াইট হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভাল করে কথা পর্যন্ত বলেন নি প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। সে সময় ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক যতটা শীতল, ততটাই উষ্ণ পাকিস্তানের সঙ্গে। তার উপর ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে নিক্সনের ছিল বেশ গলায় গলায় পিরিত। বাংলাদেশ নিয়ে ভারত শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধেই যাবে, বুঝতে পেরে সামনে পেয়ে ইন্দিরাকে অপমান করতে ছাড়েন নি দুর্বিনীত নিক্সন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে নিভৃতে আলাপকালে ভারতের মহিলা প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে যে শব্দ উচ্চারণ করতেন তা ছাপার অযোগ্য। গত ৫২ বছরে গঙ্গা-সিন্ধু-মিসিসিপি দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। হেনরি কিসিঞ্জার শতবর্ষ ছুঁয়ে আজও জীবিত। কিসিঞ্জারের মস্তিষ্ক পূর্ণ সচল এবং দুনিয়ার সব খোঁজখবর তিনি রাখেন। কুখ্যাত অথবা বিখ্যাত এবং অবশ্যই বিতর্কিত এই মার্কিন কূটনীতিক নিশ্চয় অনুভব করতে পারছেন কীভাবে সময় পাল্টায় এবং ইতিহাস বদলা নেয়।
নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী- যাঁকে ১৮ বছর আগে ভিসা দিতেই অস্বীকার করেছিল আমেরিকা, আজকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সবথেকে সম্মানিত অতিথি তিনিই। একাত্তরের তিক্ততা ধূসর অতীত। ভারত-মার্কিন সম্পর্ক বহুদিন হল বেশ মধুর। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ও ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর পৃথিবীর দুই বৃহৎ গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে আগের দূরত্ব বজায় থাকার বিশেষ কোনও কারণ ছিল না। পিভি নরসিমা রাওয়ের জামানায় ভারতে দুটি বড় পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল- একটি ভারতের আর্থিক ব্যবস্থায় সংস্কার আরেকটি বিদেশ নীতিতে পরিবর্তন। ১৯৯১ সালে মনমোহন সিংয়ের পরামর্শ মেনে রাও সাহস করে অর্থ ব্যবস্থার সংস্কারে হাত না দিলে আমাদের পরিণতি পাকিস্তানের মতো হতে পারত। সংস্কারের সৌজন্যে ভারতের অর্থনীতি যত উন্মুক্ত ও উন্নত হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের গুরুত্ব ততই বেড়েছে। ৯০-এর দশকের মধ্যভাগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল বিশ্ব অর্থনীতির দুই উদীয়মান শক্তির একটি কমিউনিস্ট চিন তো অপরটি চিনের প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক ভারত। ভূ-রাজনীতিতে আধিপত্য ধরে রাখার তাগিদে তো বটেই নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থের খাতিরেও ভারতকে মিত্র হিসেবে বেছে নেয় আমেরিকা।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নীতি-আদর্শ মুখের বুলি মাত্র, সবাইকে চালায় আসলে বৈষয়িক স্বার্থ। চিরকাল দুর্বল পায় অনুকম্পা কিন্তু শক্তিমানের জন্য বরাদ্দ থাকে সমীহ। আমেরিকার সঙ্গে ভারতের স্বার্থ যেখানে খাপে খাপে মিলে যায়, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই হাত মেলাতে দিল্লির আগ্রহ বেশি। কিন্তু যেখানে হাত মেলালে আখেরে লাভের চাইতে লোকসান অধিক সেখানে ভারত কেন হাত বাড়িয়ে দেবে। ভারতের এই দৃঢ় অবস্থান হোয়াইট হাউসকে বহুবার বহু ইস্যুতে নাখোশ করেছে। কিন্তু দিন শেষে আমেরিকাকেও ভাবতে হয়েছে ভারতের সঙ্গে ভাব নষ্ট করলে তার কতটা ক্ষতি! দিল্লিতে সরকার বদল হলেও দেশের যে নীতিতে বদল হয় না তার নাম বিদেশ নীতি। নরসিমা রাওয়ের আমল থেকে পররাষ্ট্র নীতির যে ধারাবাহিকতা ‘সাউথ ব্লক’ অনুসরণ করে আসছে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে তার বড় কিছু বিচ্যুতি ঘটান নি। তবে মোদী জামানায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের আত্মবিশ্বাস, গ্রহণযোগ্যতা এবং গৌরব যে অনেক বেড়েছে শশী থারুরের মতো কংগ্রেস নেতাও তা স্বীকার করেন। কূটনীতির দুনিয়ায় সম্পর্ক, বন্ধুত্ব শব্দগুলি আপেক্ষিক। পরিস্থিতি ও প্রয়োজন সাপেক্ষে পারস্পরিক সম্পর্ক কখনও একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ হয় কখনও তাতে তৈরি হয় দূরত্ব। বন্ধু হোক কি শত্রু- নিজের স্বার্থ রক্ষায় ভিন দেশের সঙ্গে গুছিয়ে দর কষাকষি করতে পারাটাই হচ্ছে বৈদেশিক নীতির মূল কথা। মোদী বানিয়া মানুষ। দর কষাকষি ভালোই জানেন। তবে অনুকম্পার বদলে যে সম্ভ্রম আদায় করে নেয়, দরাদরিতে চিরকাল তার পাল্লাই ভারি থাকে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে যে টানাপোড়েন চলছে তাতে একটু হলেও ঝুঁকতে কিন্তু হয়েছে পরের জনকেই।
যারে দেখতে নারি তারে কীভাবে বিড়ম্বনায় ফেলতে হয়, তা আমেরিকার থেকে ভাল আর কেউ জানে না। ইউক্রেন প্রশ্নে আমেরিকাকে অগ্রাহ্য করে ভারত প্রকারান্তরে পুতিনের পাশে দাঁড়িয়েছে। এতে বাইডেন সাহেবের গুস্সা আসাই স্বাভাবিক। ঘরে-বাইরে অনেকেই এই ভেবে আশ্বস্ত হচ্ছিলেন, এইবার মোদী সরকারকে চাপে ফেলবে বাইডেন প্রশাসন। মোদীর আমেরিকা সফরের পর তাদের আশা হতাশায় পরিণত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। গণতন্ত্রের অবনমন, স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা, মানবাধিকার লংঘন এবং সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগে পশ্চিমের বিভিন্ন লবির ভারতকে খুচখাচ খোঁচানো নতুন কিছু নয়। এইসব প্রশ্নে এইবার যাতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অফিশিয়ালি কিছু জ্ঞান, পরামর্শ এবং হুমকি দেন; সেই তাগিদে মোদীর সফরের আগে খানিক চেষ্টাচরিত্র করেছিল একটি মহল। মুখোমুখি বৈঠকে মোদীকে কিঞ্চিত কড়া কথা শোনাতে বাইডেনকে চিঠিও দিয়েছিলেন আমেরিকার আইনসভার ৭৫ জন সদস্য (১৮ জন সেনেটর, ৫৭ জন হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভসের সদস্য)। মোদীর সফরের মধ্যেই বাইডেনকে অনুরূপ পরামর্শ দেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। যদিও মোদীকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিয়ে জ্ঞান দেওয়ার চাইতে বাইডেনের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিজের দেশের স্বার্থ রক্ষা। এবং বাইডেন সেটাই করেছেন।
তিন দিনের সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যাতে প্রীত থাকেন, তাতে কোনও কার্পণ্য করে নি আমেরিকা। কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন মোদী। এই নিয়ে যা দ্বিতীয়বার। খুব খাতিরের কেউ না হলে দ্বিতীয়বার কাউকে এই সুযোগ দেয় না আমেরিকা। ঘটনাটি প্রমাণ করে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যতটুকু অবনতি হয়েছে তা দ্রুত সারিয়ে ফেলতে কতটা মরীয়া বাইডেন প্রশাসন। দেশের ভেতরে যাঁরা মোদীর রাজনৈতিক শত্রু, তাঁরাও মানেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে মোদী নজর কাড়তে জানেন। ৭৫ জন ‘কংগ্রেস’ সদস্য নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে জো বাইডেনকে চিঠি দিলেও কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে মোদীর ভাষণ বয়কট করেছেন ‘ডোমোক্র্যাট’ দলের মাত্র চারজন সদস্য। ভরা অধিবেশনে মোদীর ৪৮ মিনিটের ভাষণে ১৫ বার ‘মোদী মোদী’ রবে উঠে দাঁড়ান কংগ্রেসম্যানরা, ৭৯ বার ওঠে করতালির ঝড়। নিজের ভাবমূর্তি নির্মাণে নরেন্দ্র মোদী যথেষ্টই সাবধানী, যত্নবান এবং সফলও। নিঃসন্দেহে তিনদিনের আমেরিকা সফরের সাফল্যকে দেশে ফিরে রাজনৈতিক প্রচারে ব্যবহার করার সুযোগ থাকবে মোদীর সামনে। এবং বলার অপেক্ষা রাখে না সুযোগের সদ্ব্যবহারে চেষ্টার ত্রুটি রাখবেন না মোদী।
বাইডেন সরকারের কূটনীতিকদের বিলম্বিত বোধোদয় হয়েছে, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতের চেয়ে শক্তিশালী কৌশলগত মিত্র আমেরিকার জন্য আর কেউ হতে পারে না। চিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাণিজ্যিক ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়তর করার বাধ্যবাধকতা আমেরিকার আছে। তাই ট্রাম্পের থেকে মোদীকে আদর-আপ্যায়ন কিছু কম করেন নি বাইডেন। ভারত সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। বলা বাহুল্য, সদ্ব্যবহারে দ্বিধা করে নি মোদী সরকার।আমেরিকার সঙ্গে যে কয়টি চুক্তি স্বাক্ষর করার লক্ষ্য নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে নেমেছিলেন মোদী, তার সবকটিই সম্পন্ন করেছেন। এইসব চুক্তি ভারতের প্রতিরক্ষা স্বার্থ চরিতার্থ করার পাশাপাশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা এবং টেলি যোগাযোগের উন্নতিতে সহায়ক হবে। নতুন এইচ বি ওয়ান ভিসা নীতি কার্যকর হলে আমেরিকায় ভারতীয় অভিবাসীদের দীর্ঘদিনের একটি চাওয়া পূর্ণ হবে। আমেরিকা এখনও পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি। বৃহত্তম শক্তিকে নিজের উপকারে লাগানোর সুযোগ ভারতের সামনে।
Feature Image Credit- Official FB page of Narendra Modi.