সুপ্রিম কোর্টে বহাল হাইকোর্টের রায়, পঞ্চায়েত ভোট কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই, কমিশন ভর্ৎসিত শীর্ষ আদালতে - nagariknewz.com

সুপ্রিম কোর্টে বহাল হাইকোর্টের রায়, পঞ্চায়েত ভোট কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই, কমিশন ভর্ৎসিত শীর্ষ আদালতে


দিল্লি: বাংলায় পঞ্চায়েত ভোট কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই হচ্ছে।‌ মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টের রায়কেই বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট। গত বৃহস্পতিবার রাজ্যের সব জেলাতেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় পঞ্চায়েত ভোট করার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। পাশাপাশি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে বাহিনী চেয়ে আবেদন করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতিরা। প্রথমে হাইকোর্টের নির্দেশ মানা হবে আশ্বাস দিলেও চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ভোল পাল্টে ফেলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা। শনিবার হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন একযোগে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হ‌ওয়ার আগে থেকেই বিরোধীদের দাবি ছিল- বুথে বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাই। রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন যে তাতে কর্ণপাত করবে না, তা জানাই ছিল বিরোধী দলের নেতাদের। দায়িত্ব নেওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই সবাইকে চমকে দিয়ে গত ৮ জুন বিকেলে পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘন্ট ঘোষণা করে দেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা। ৭৪ হাজার আসনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয় মাত্র ছয়দিন।‌ গত ৯ জুন পঞ্চায়েত ভোটের বিজ্ঞপ্তি ঘোষণার দিনেই পাঁচদফা আর্জি নিয়ে হাইকোর্টে মামলা করে কংগ্রেস ও বিজেপি। পাঁচদফার মধ্যে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়সীমা বৃদ্ধির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় ভোটের দাবি ছিল মুখ্য।

মনোনয়ন পর্বের প্রথম দিন থেকেই রাজ্য জুড়ে অশান্তি শুরু হয়ে যায়। প্রথম দিন‌ই মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামে কংগ্রেসের এক কর্মীকে বাড়িতে ঢুকে গুলি করে মারে দুষ্কৃতীরা। গত ১৩ জুন প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ স্পর্শকাতর ৭ জেলার ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছিল। ইতিমধ্যেই বিরোধীদের মনোনয়ন আটকাতে দিকে দিকে সন্ত্রাস শুরু হয়ে যায়। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ঘিরেও বোমাবাজির ঘটনা ঘটতে থাকে। আইএস‌এফ বনাম তৃণমূলের সংঘর্ষে ভাঙড়ের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। তারপরেও ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ কার্যকর করতে কোনও পদক্ষেপ করে নি রাজ্য নির্বাচন কমিশন। উল্টে নির্দেশ পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়ে ডিভিশন বেঞ্চে যায় সরকার ও কমিশন। মনোনয়ন ঘিরে জেলায় জেলায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে কমিশনের উদাসীনতা দেখে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে বিচারপতিদের‌ও। ১৫ জুন রাজ্যের প্রত্যেকটি জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেন‌ প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে বাহিনী চেয়ে আবেদন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে ৪৮ ঘন্টার সময়সীমাও বেঁধে দেয় ডিভিশন বেঞ্চ।

পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন তৃণমূল ও আইএস‌এফ-এর সংঘর্ষে ভাঙড় যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।‌ বৃষ্টির মতো বোমা পড়তে থাকে ভাঙড় ১ ও ২ নম্বর বিডিও অফিস ঘিরে। দুই পক্ষে চলে তুমুল গুলির লড়াই। পুলিশ ছিল দর্শকের ভূমিকায়। শুধু ভাঙড়েই তিনজনের লাশ পড়ে। মনোনয়ন পর্বের ছয়দিনে হিংসায় রাজ্যে ৭ জনের প্রাণ গিয়েছে। মারধরের অভিযোগ অগুণতি। বোমা বিস্ফোরণে আহত হ‌ওয়ার ঘটনা একাধিক। বোমা ফেটে জখম হয়েছে শিশুরাও। এই পরিস্থিতিতেও হাইকোর্টের কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বরাবরই স্পর্শকাতর। পঞ্চায়েত ভোটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার কমিশনের হাতে না রেখে নিজের হাতে রেখেছে সরকার। প্রথমে হাইকোর্টের নির্দেশ মানার কথা বললেও পরে নবান্নের চাপেই কমিশন সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয় বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের প্রশ্নে ছাড় নয়

সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চে শনিবার মামলার ই-ফাইলিং করার পরেই জরুরী ভিত্তিতে শুনানি চায় রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশন। পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের মামলায় একতরফা শুনানির ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট যাতে কোনও সিদ্ধান্তে না আসে, এই আশঙ্কায় আগেই ক্যাভিয়েট দাখিল করে রেখেছিল কংগ্রেস ও বিজেপি। সোমবার বিচারপতি বিভি নাগরত্ন ও বিচারপতি মনোজ মিশ্রের ডিডিশন বেঞ্চ মামলাটি মঙ্গলবার শুনানির অনুমতি দেয়। রাজ্য ও কমিশনের কোন‌ও যুক্তিই ধোপে টিকল না শুনানিতে। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে হাইকোর্টের রায়‌ই বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। শুনানিতে বিচারপতিদের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয় রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে। শীর্ষ আদালতের দুই বিচারপতি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ ভোট নিশ্চিত করতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। সেই নির্দেশে হস্তক্ষেপ করতে আমরা আগ্রহী ন‌ই। তাই রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের স্পেশাল লিভ পিটিশন খারিজ করা হল।”

রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে ধুয়ে দিল শীর্ষ আদালত

সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক করে দিয়ে বলে, “নির্বাচন করানো মানে হিংসার লাইসেন্স দেওয়া নয়। হিংসা কখনও নির্বাচনের সহযোগী নয়।” ২০১৩ ও ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটেও রাজ্যে ব্যাপক হিংসা ও সন্ত্রাস হয়েছিল। এবার‌ও মনোনয়ন ঘিরে হিংসা-সংঘর্ষ ঘটছে। শুনানি চলাকালে বিচারপতি বিভি নাগরত্ন আগের দুই পঞ্চায়েত ভোটে হিংসার কথা তোলেন, মনোনয়ন ঘিরে হানাহানির প্রসঙ্গ‌ও উত্থাপন করেন তিনি। বিচারপতি বলেন, “ভোটে কোনও রকম অশান্তি হবে, সেটা আশা করা যায় না। অতীতে রাজ্যে এমন ঘটনার উদাহরণ আছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি সব দিক খতিয়ে দেখেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এই নির্দেশে অসুবিধার কিছু দেখছি না।”

পঞ্চায়েত ভোটে হিংসা: ভাঙড়ে নিহতের লাশ রাস্তায়। ফাইল ফটো

পঞ্চায়েত ভোটের নিরাপত্তা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আদৌ কোনও মাথাব্যথা আছে কিনা, শুনানিতে প্রকারান্তরে এই প্রশ্ন‌ও তুলেছেন বিচারপতিরা। রাজ্যের আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বিচারপতিরা জানান- “তাদের হাতে পর্যাপ্ত পুলিশ নেই বলেই তো রাজ্য সরকার আধ ডজন রাজ্য থেকে পুলিশ চেয়েছে। অন্য রাজ্যের পুলিশের জায়গায় কেন্দ্রীয় বাহিনী এলে সমস্যা কোথায়?” নির্বাচন কমিশন রাজ্য সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরোধিতা করায় তাজ্জব বিচারপতি বিভি নাগরত্ন ও বিচারপতি মনোজ মিশ্র। তাঁরা বলেন, “কমিশন কীভাবে হাইকোর্টের নির্দেশের বিরোধিতা করতে পারে? আপনারা রাজ্যের কাছে বাহিনী চেয়েছেন, সেই বাহিনী কোথা থেকে এল তাতে আপনাদের কী? বাহিনী রাজ্য থেকে এল, নাকি পাশের রাজ্য থেকে এল, নাকি কেন্দ্রীয় বাহিনী এল, তাতে আপনারা কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন? আপনাদের এস‌এলপি-র গ্রহণযোগ্যতা কী?”

শুভেন্দুর সুপ্রিম সন্তোষ

সুপ্রিম কোর্টে হাইকোর্টের নির্দেশকে বহাল রাখায় পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন নিয়ে সব বাধা কাটল। এই মামলার অন্যতম পার্টি ছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে শুভেন্দু বলেন, “রাজ্য সরকারের গালে লিগাল থাপ্পড় মেরেছে সুপ্রিম কোর্ট। আমি অত্যন্ত খুশি।” কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে হাইকোর্টের রায় অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হচ্ছে কিনা, সেই দিকেও তাঁরা নজর রাখবেন বলে জানান বিরোধী দলনেতা। যতবার নির্দেশের ব্যতিক্রম হবে ততবারই তিনি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন শুভেন্দু অধিকারী।

Feature Image is Representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *