যে আশঙ্কা আমরা সবাই করছিলাম, তা-ই শেষ পর্যন্ত সত্যি হল। শুক্রবার (২৮ এপ্রিল, ২০২৩) বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকে নিয়োগ দুর্নীতির মামলা সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। গত সোমবারই ( ২৪ এপ্রিল, ২০২৩) খারাপ কিছুর আঁচ পাওয়া গিয়েছিল চন্দ্রচূড়ের কথায়। নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত এক গুচ্ছ মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন। নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত সবকটি মামলাই, নাকি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিবিআই জেরা সংক্রান্ত মামলাটিই কেবল জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকে সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়।
যত দূর জানা যাচ্ছে; কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ সংক্রান্ত দুটি মামলা, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকে অন্য কোনও বিচারপতির বেঞ্চে স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এই ধরণের কোনও নির্দেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে দিতে পারেন কিনা, তা নিয়েই আইনজ্ঞ মহলে বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় যেমন মনে করেন, এ’ভাবে মামলার বেঞ্চ বদলের নির্দেশ দিতে পারে না সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্ট কী পারে আর কী পারে না, তা নিয়ে আইনজ্ঞ মহলের নানা রকম দৃষ্টিভঙ্গি থাকতেই পারে। কিন্তু আমরা যারা বাংলার সাধারণ মানুষ, তারা অত আইনকানুন বুঝি না, আইনের জটিল মারপ্যাঁচ বুঝি না। কিন্তু আমরা একটা কথাই সাফ সাফ বুঝি, চাকরিচোরদের শাস্তি হওয়া উচিত, নিয়োগ দুর্নীতির নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত এবং নিয়োগ দুর্নীতির সমস্ত মামলায় চাকরি বঞ্চিতদের ন্যায় পাওয়া উচিত। তাই আইনজ্ঞ মহলের মতামত নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।
সিবিআই-ইডির তদন্ত সহ নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত অধিকাংশ কড়া নির্দেশ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকে এসেছে। এইজন্যই জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায় চাকরি প্রত্যাশী সহ বাংলার অগণিত সাধারণ মানুষের কাছে ‘হিরো’। আবার একই কারণে তিনি অনেকের ‘চোখের বালি’। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের সব থেকে বড় অভিযোগ, তিনি ২০২২-এর ১৯ সেপ্টেম্বর একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বিচারপতি যে মামলার বিচারকার্যে রত আছেন, সেই বিষয়ে গণমাধ্যমে কোনও মতামত দিতে পারেন না- বিচারব্যবস্থায় এটাই রীতিনীতি ও বিধি। যদিও বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, তিনি ‘ব্যাঙ্গালোর প্রিন্সিপলস’-এর বাইরে গিয়ে কোনও কিছু করেন নি। গণমাধ্যমে কোন কোন বিষয়ে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা মুখ খুলতে পারবেন, সেই ব্যাপারে কিছু নির্দেশিকা দেওয়া আছে ‘ব্যাঙ্গালোর প্রিন্সিপলস অব জুডিশিয়াল কনডাক্ট’-এ।
সিবিআই প্রয়োজন মনে করলে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে- সম্প্রতি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ধৃত কুন্তল ঘোষের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। হাইকোর্টের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যান অভিষেক এবং প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ হাইকোর্টের নির্দেশের উপরে স্থগিতাদেশ দেয়। গত ২৪ এপ্রিল এই মামলার শুনানি চলাকালে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ তুলে মামলা অন্য বেঞ্চে সরানোর দাবি জানান অভিষেকের আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। কলকাতা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে সাক্ষাৎকার সংক্রান্ত হলফনামা পড়ে দেখার পর সিঙ্ঘভির অভিযোগকেই মান্যতা দিলেন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। নিয়োগ দুর্নীতির মামলা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দিতে কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এই ‘ব্রেকিং নিউজ’ গণমাধ্যমগুলিতে সম্প্রচারিত হওয়া মাত্রই সামাজিক মাধ্যমে উথালপাথাল শুরু হয়ে যায়। সামাজিক মাধ্যমে জনগণের মনোভাব খুব স্পষ্ট- বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মিডিয়ায় মুখ খুলে ভুল করেছেন কি ঠিক করেছেন জানি না, কিন্তু ওনার বেঞ্চ থেকে মামলা সরিয়ে দেওয়া মানছি না। জনগণের আশঙ্কা, মামলা জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকে সরে গেলে ন্যায় বিচার ব্যাহত হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কারা আনন্দে লাফাচ্ছে, কারা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করে টুইট করছে, তা দেখাই যাচ্ছে। মোদ্দা কথা- মামলা কাঁচিয়ে গেলে, তদন্ত বিশ বাঁও জলে তলিয়ে গেলে যাদের স্বস্তি, তারা বাদ দিয়ে রাজ্যের আর কেউ চন্দ্রচূড়ের নির্দেশে আনন্দিত নন। বরং জনগণের মনটাই ভেঙে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ।
সাধারণ মানুষ তো জানে, চাকরি কীভাবে কেনাবেচা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। দুর্নীতির কারণে চাকরি বঞ্চিতরা ৭৭৫দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশেই বহু মাত্রিক নিয়োগ দুর্নীতির সিবিআই তদন্ত শুরু হয়েছে। আর সিবিআই-ইডি নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তভার হাতে না নিলে এই মামলার আদৌ কোনও অগ্রগতি হত না বলে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস। শেষ পর্যন্ত জনগণের একটাই কথা- হাকিম নড়েছে মেনে নিচ্ছি কিন্তু হুকুম নড়লে চুপ করে বসে থাকব না। জাস্টিস অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যে পথ দেখিয়ে গেলেন, সেই পথ থেকে বিচার প্রক্রিয়া বিচ্যুত হলে জনমানসে বিচারব্যবস্থার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে বলে মনে হয় না। বরং জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়ের মাথায় কেন গণদেবতার আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে, দয়া করে বাংলায় এসে একটু তলিয়ে দেখে যান দেশের মহামান্য প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়।