ওয়াশিকুর রহমান শুভ্র, ঢাকা: শেখ হাসিনার জামানায় বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতেরা চিপায়-চাপায় থাকতেন। তাঁদের উপর কড়া নজরদারি রাখতেন সরকারের গোয়েন্দারা। ইউনূসের জামানায় ব্যস্ত সময় পার করছেন ঢাকার পাক কূটনীতিকরা। ইসলামাবাদ মনে করছে, দীর্ঘদিন পর আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ এসেছে তাদের সামনে। ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাসে তাই কর্মব্যস্ততা বেড়েছে। ৫ অগাস্টের পর থেকেই বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ আহমেদ মারুফের অতি ব্যস্ততা কারও নজর এড়ায় নি। ইতিমধ্যেই গোটা বাংলাদেশ মারুফের চষা হয়ে গেছে। তবে মারুফের আকস্মিক ছুটিতে যাওয়াকে ঘিরে রহস্য দানা বেঁধেছে ঢাকার রাজনৈতিক মহলে।
বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থী যে রাজনীতিকেরা হাসিনার আমলে গর্তে ঢুকে থাকতেন, ৫ অগাস্ট থেকে তাঁরা হাতে আসমান পেয়েছেন বললে ভুল হয় না। পাকিস্তানের জন্য দিল মহাব্বতে ভরা, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনে এমন উপদেষ্টার সংখ্যা কম নয়। হাসিনা জামানায় নিষিদ্ধ জামায়াত সহ একাধিক পাকিস্তানপন্থী দল এখন বাংলাদেশে সক্রিয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ইতিমধ্যেই জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন তাঁরা। পাকিস্তানের সঙ্গে মাখামাখিতে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের খানিকটা চক্ষুলজ্জা থাকলেও হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস ইসলামের সেই বালাই নেই।
উন্মত্ত জনতাকে জড়ো করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়ি যে রাতে গুঁড়িয়ে দিল হাসনাতরা, ইউনূসের নির্দেশে স্থানুবৎ হয়ে সেই দৃশ্য দেখেছিল পুলিশ ও সেনাবাহিনী। এনসিপির হুমকির সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে এবার আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করল মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপির আন্দোলনে লোকসমাগম হচ্ছিল না। পরে জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম সহ বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠী থেকে দলে দলে লোক গিয়ে শাহবাগে ভিড় বাড়ায়। ঢাকা সহ গোটা বাংলাদেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি দেয় আন্দোলনকারীরা। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন জারি না হলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’ ঘিরে ফেলা হবে, এই হুমকি শোনা মাত্রই ভয়ে হাসনাত-সারজিসদের দাবি মেনে নেন মুহাম্মদ ইউনূস।
ঢাকায় যা ঘটছে, ভীষণ উপভোগ করছে ইসলামাবাদ
৫ অগাস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্য ইসলামাবাদে বসে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছেন পাকিস্তানের রাজনীতিকরা। ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে দেখে উল্লসিত হয়েছেন তাঁরা। পাকিস্তানের মিডিয়ায় সেই খবর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছে। ১২ মে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ঘোষণাকে একাত্তরের বদলা হিসেবে দেখছে পাকিস্তানের একটি মহল। শেখ মুজিবকে কীভাবে ক্ষমা করে পাকিস্তান! মুজিবের কারণেই পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়েছে বলে মনে করেন পাকিস্তানের শাসকেরা। আজ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ করা অপরাধ। জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগ ও তার সমস্ত অঙ্গ সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। এমনকি জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…’ নিয়েও টানাটানি শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের পুলকিত হওয়ার মতো সমস্ত ঘটনাই সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ঘটে গেছে।

পালা বদলের বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ আহমেদ মারুফ একটি আলোচিত নাম। ২০২৩ সালে ঢাকায় পাকিস্তানের ‘হাই কমিশনার’ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মারুফ। শেখ হাসিনার জামানায় রুটিন কাজের বাইরে মারুফের বিশেষ কোনও কাজ ছিল না। কিন্তু ৫ অগাস্টের পর থেকে যত দিন গিয়েছে পাক হাইকমিশনারের ব্যস্ততা বেড়েছে। মারুফের সঙ্গে মাখামাখি করতে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে কম্পিটিশন শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানের কূটনীতিকদের সঙ্গে মেলামেশায় এখন আর তাঁদের কোনও লুকোছাপা, লজ্জাশরম নেই। বরং পাকিস্তান হাইকমিশন আয়োজিত কোনও পার্টিতে দাওয়াত পাওয়া গৌরবের ব্যাপার।
পাক হাইকমিশনার হঠাৎ ছুটিতে গেলেন কেন?
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেক আগুনখোর নেত্রীকে আইএসআই হানিট্র্যাপের কাজে লাগিয়েছে বলে ঢাকার বাতাসে গুঞ্জন। ইউনূসের প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত একাধিক মহিলা আধিকারিক ও ঢাকার অভিজাত সমাজের অনেক সুন্দরী স্বেচ্ছায় পাক কূটনীতিকদের শয্যাসঙ্গিনী হচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। দিন কয়েক আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিভাগের সহকারী পরিচালক হাফিজা হক শাহের সঙ্গে কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ।

বিষয়টি জানাজানি হলে মারুফের উপর অসন্তুষ্ট হয় ইসলামাবাদ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কক্সবাজার থেকেই অনির্দিষ্টকালের ছুটি নিয়ে ঢাকায় ফিরে দুবাইয়ের ফ্লাইট ধরেন প্লেবয় মারুফ।সুন্দরী হাফিজাকে হানিট্র্যাপের কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ফাঁসানোর পরিকল্পনা ছিল আইএসআইয়ের। কিন্তু হাফিজা হক শাহের সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের ঘনিষ্টতার খবর ভালভাবে নেয় নি পাকিস্তান সরকার।
মারুফ-নাফসিন মাখামাখির নেপথ্যে কী?
নাফসিন মেহরাজ আজিরিন নামে এক তরুণীর গতিবিধি নিয়েও গুঞ্জন উঠেছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী নাফসিনকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগের সাম্প্রতিক ব্লকেডে সামনের সারিতে দেখা গেছে। পাকিস্তানকে সমর্থনের প্রশ্নে কোনও দ্বিধা নেই বিহারি বংশোদ্ভূত নাফসিনের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান ভাঙার ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে মনে করা নাফসিন মেহরাজ আজিরিন জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনেরও পক্ষে।

ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে যে তাঁর অবাধ যাতায়াত নিজের ফেসবুক পেজে সগর্বে সেই প্রমাণ দিয়েছেন নাফসিন। লম্বা ছুটিতে যাওয়া পাক হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফের সঙ্গে নাফসিনের খাতির চোখে পড়ার মতো। প্রবল ভারতবিদ্বেষী এই তরুণীকে বাংলাদেশে সক্রিয় আইএসআইয়ের এজেন্টরা গত দু’বছর ধরেই নানাভাবে কাজে লাগাচ্ছে বলে খবর।
Feature graphic is representational and designed by NNDC.