জনসমর্থন হারিয়ে মাওবাদীরা স্রেফ জঙ্গিতে পরিণত হয়েছে। এদিকে যাদের ছেলেমেয়েরা আমেরিকায় সেটেল্ড, তারাও মাওবাদীদের জন্য কাঁদে! লিখলেন উত্তম দেব-
অলআউট অপারেশনে যাওয়ার আগে মাওবাদীদের মূলস্রোতে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সিপিআই (মাওয়িস্ট) নেতৃত্বের উচিত ছিল নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সুযোগটির সদ্ব্যবহার করা। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এ যাত্রায় সরকার তাদের শ্রীলঙ্কার এলটিটিই-র মতো পিষে না মারা পর্যন্ত থামবে বলে মনে হয় না।
বামপন্থী গেরিলারা কোথাও সফল হয় নি, ভারতে তো প্রশ্নই ওঠে না
পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী মার্ক্সিস্ট গেরিলা গোষ্ঠী ছিল কলম্বিয়ার FARC. ২০১৭ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে অস্ত্রত্যাগ করে মূলস্রোতের রাজনীতিতে যুক্ত হয় ফার্ক। পেরুর মাওবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীটির নাম ছিল ‘শাইনিং পাথ’। হিংসাত্মক কর্মকান্ডে ভীষণ পটু ছিল দলটি। কিন্তু দলের প্রধান আবিমায়েল গুজমান গ্রেফতার হওয়ার পর পেরুর এই দুর্ধর্ষ মাওবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীটি কার্যতঃ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কারাবন্দি অবস্থাতেই ২০২১-এ ৮৬ বছর বয়সে গুজমানের মৃত্যু হয়। এল সালভাদর, গুয়াতেমালা সহ ল্যাটিন আমেরিকার সব দেশে এমনকি ঘরের পাশে নেপালে বামপন্থী, মাওপন্থী গেরিলারা সশস্ত্র ইউনিট ভেঙে দিয়ে সাংবিধানিক রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছে। একমাত্র পূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইনে একটি কমিউনিস্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী এখনও খানিকটা সক্রিয়।

কলম্বিয়ার ফার্ক বা পেরুর শাইনিং পাথের সঙ্গে তুলনা করলে ভারতের মাওয়িস্টদের অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ, সাংগঠনিক শক্তি ও ‘স্ট্রাইকিং ক্যাপাসিটি’ কিচ্ছু নয়। ধারাবাহিকভাবে শক্তিক্ষয় হতে হতে মাওবাদীদের সংগঠন সাম্প্রতিক সময়ে সবথেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভারতের মাওবাদীরা যখন সবথেকে শক্তিশালী অবস্থানে ছিল, তখনও তাদের নিশ্চিহ্ন করতে সরকারের এক বছরের বেশি সময় লাগতো না যদি দেশের আধা সামরিক বাহিনীগুলির মোট শক্তির মাত্র পনেরো শতাংশ সর্বাত্মক প্রয়োগ করা হত।
সরকার মানবিক ও রাজনৈতিক কারণে মাওবাদীদের উপর নিয়ন্ত্রিত বলপ্রয়োগ করে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে, যেহেতু অভ্যন্তরীণ এই বিদ্রোহের পেছনে স্থানীয়ভাবে কিছু আর্থসামাজিক বঞ্চনা অনেকাংশে দায়ী ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার এবার মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অলআউট অপারেশনে নেমেছে। যার মোকাবিলা করার মতো জনবল ও অস্ত্রবল- কোনওটাই বর্তমানে মাওবাদীদের নেই। কাজেই তাদের বিনাশ অনিবার্য।
জনসমর্থনহীন জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে মাওবাদীরা
দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাওবাদীদের গ্রহণযোগ্যতা ফুরিয়েছে। আর্থ-সামাজিক যে বৈষম্যের প্রতিক্রিয়ায় ঝাড়খণ্ড, ছত্তীশগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশে, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র ও ওড়িশার জনজাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে মাওবাদীদের উত্থান, তার প্রতিবিধান অনেকাংশে সম্ভব হয়েছে। বন্দুক হাতে নেওয়ার হেতু দূর হয়ে যাওয়ার পর কে আর অহেতুক বাগী হয়ে নিজের জীবন খোয়াতে যায়!
কোনও গোষ্ঠী রাষ্ট্রকে বলপ্রয়োগ দ্বারা উৎখাত করার চেষ্টা করলে রাষ্ট্র খোল-করতাল বাজিয়ে কীর্তন গায়; পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত এমন কোনও বৈষ্ণব রাষ্ট্রের জন্ম হয় নি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাতে নেমে রাষ্ট্রের কাছে মানবাধিকার প্রত্যাশা করে একমাত্র গর্দভরা। প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার খেলায় আবার কীসের দয়ামায়া, অনুকম্পা? মাওবাদীরা যদি কথিত জনযুদ্ধ করতে করতে দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারত, তবে মোদী-শাহের গর্দান থাকত? কলকাতার কয়েকজন সাংবাদিক, যাঁদের একজন আবার পঞ্জি স্কিমে জনগণের টাকা মারা নিকৃষ্ট এক ব্যবসায়ীর টাকায় ফিল্ম বানিয়েছিলেন, সিপিআই (মাওয়িস্ট) এর সাধারণ সম্পাদক নাম্বালা কেশব রাও ওরফে বাসবরাজের মৃত্যুতে কেন্দে ফেসবুক ভরিয়ে ফেলেছেন।

যারা মাওবাদীদের রাজনৈতিক দর্শনে প্রভাবিত হয়ে বা অন্য একাধিক কারণে জঙ্গলে গিয়ে গেরিলা হয়েছে, তাদের অনেকেই আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। সিপিআই (মাওয়িস্ট)-এর নেতৃস্থানীয়দের মধ্যেও অনেকে হিংসাত্মক রাজনীতির অসাড়তা উপলব্ধি করতে পেরে দল ও জঙ্গল ছেড়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে এসেছেন। সরকারের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০০১ থেকে ২০২৪- এই ২৪ বছরে দেশের মাওবাদী ও নকশালপন্থী উপদ্রুত অঞ্চলগুলিতে হিংসায় প্রাণ গিয়েছে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষের। মাওবাদীরা আরও আগেই ভ্রান্ত রাজনীতি ত্যাগ করলে এত মানুষ বেঘোরে মরত না।
শহরে বসে যারা মাওবাদীদের উস্কানি দেয় তারা ভন্ড, বদমাইশ
যারা ভুল পথে পা বাড়িয়ে জঙ্গলে গিয়ে হাতে অস্ত্র ধরেছে, তাদের থেকে বেশি বিপজ্জনক সেই সব লোকেরা, যারা শহরে আরামে বাস করে জঙ্গলের মাওবাদীদের উস্কানি দেয়। এরা কেউ সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটা মাইনের চাকরি করে। কেউ বড় মিডিয়া হাউসের সাংবাদিক। কেউ ফরেন ফান্ডেড এনজিও চালিয়ে গাড়ি-বাড়ি করেছে। এদের অধিকাংশের পুত্র-কন্যা বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থায় কর্মরত, কারও ছেলেমেয়ে আমেরিকায় সেটেল্ড। বিপ্লব এদের কাছে বিলাসিতা ও বিনোদন। এরা কোনও দিন জঙ্গলে গিয়ে বন্দুক ধরবে না। নিজের ছেলেমেয়েকেও পুলিশের গুলি খেয়ে মরতে মাওবাদীদের শিবিরে পাঠাবে না। কিন্তু অবুঝমারের প্রত্যন্ত গ্রামের আদিবাসী যুবকেরা যাতে বিভ্রান্ত হয়ে ঘর ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে মাওবাদী স্কোয়াডের গেরিলা হয়ে যায়, সেই উস্কানিটা দিয়ে যাবে। মাওবাদী হয়ে যাওয়া আদিবাসী তরুণ তরুণীরা এনকাউন্টারে মরলে এরা আনন্দিতই হয়। কারণ, এরা রাজনীতি করার খোরাক পায়।

মাওবাদ যে দিনের শেষে খাওবাদ ও স্রেফ জঙ্গিবাদ তা প্রমাণিত। সিপিআই (মাওয়িস্ট) এর সাধারণ সম্পাদক নাম্বালা কেশব রাও সংঘর্ষে নিহত হলে তাই ১৫০ কোটির ভারতের বৃহত্তর সমাজ মোটেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে না। যে রাজনৈতিক সংগ্রাম জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন তা কোনও রাজনৈতিক সংগ্রামই না।