বিশেষ প্রতিবেদন: থানার আইসিদের সঙ্গে শাসকদলের নেতারা কেমন ব্যবহার করেন তা সমাজে লুকোছাপা নেই। অধিকাংশ সময়ই আড়ালের কথা আড়ালে থেকে যায়। কদাচিৎ কল রেকর্ড বাজারে ফাঁস হয়ে গেলে কিম্বা ভিডিও ভাইরাল হলে পুলিশ ও দল- উভয়কেই একটু বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, এই আর কি। তবে অনুব্রত মণ্ডল যা করে ফেলেছেন, তাতে এই যাত্রায় তাঁর পলিটিক্যাল কেরিয়ার বাঁচানো মুশকিল। গরু পাচার মামলায় জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে আসার পর থেকেই বীরভূম জেলায় নিজের রাজ্যপাট বুঝে পান নি কেষ্ট মন্ডল। ছিলেন বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি। জেলা সভাপতি যখন জেলে, তখন বীরভূম জেলায় দল পরিচালনা করার জন্য কোর কমিটি গড়ে দিয়েছিলেন মমতা।
অনুব্রত মণ্ডলের অবর্তমানে বীরভূম জেলা তৃণমূলে প্রতিদ্বন্দ্বী কাজল শেখের কর্তৃত্ব বেড়েছে। একজন সভাপতির বদলে নয় সদস্যের কোর কমিটির মাধ্যমে অনুব্রতের অনুপস্থিতিতে বীরভূম জেলায় তৃণমূল দলটা চলত। অনুব্রত বিহীন তৃণমূল বীরভূম জেলায় ড্যাং ড্যাং করে পঞ্চায়েত জিতেছে এমনকি লোকসভা নির্বাচনেও ঘাসফুলের জয়জয়কার। কেষ্ট যখন জেলে, তখন পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা- দলের ভাল ফলের পেছনে কাজল শেখের বড় অবদান আছে বলে খবর। মোট দুই বছর জেলে ছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। দেড় বছর তিহাড়ে। ততদিনে কোপাই নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। দলে অনুব্রতের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। গত বছরের ৩ অক্টোবর বোলপুরে ফিরে কেষ্ট বুঝতে পারেন, হৃত সাম্রাজ্য ফিরে পেতে অনেক মেহনত করতে হবে তাকে।
রাজা-রানীদের কাছে ক্ষমতা ছাড়া আপন কেউ নয়। গরু পাচার মামলায় জেল খেটে ঘরে ফিরে কেষ্টও বুঝতে পারেন, তাঁর মাথা থেকে দিদির হাতটি সরে গেছে। অনুব্রত দলের জেলা সভাপতি হিসেবে বীরভূমে ফিরলেও দলের রাশ ফিরে পান নি। জেলে যাওয়ার আগে দলে ও প্রশাসনে যে দাপট দেখাতেন, তা দেখাতে গিয়ে দলের ভেতর থেকে পদে পদে বাধা পাচ্ছিলেন। কেষ্ট ফিরে এসে নিজের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে অভিযানে নামতেই বীরভূম জেলা তৃণমূলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। গত ১৬ মে একটি ফর্মান জারি করে বীরভূম জেলা তৃণমূল কমিটি থেকে জেলা সভাপতি পদটিই তুলে দেন বিরক্ত মমতা।নয় সদস্যের কোর কমিটিতে পদহারা কেষ্টর ঠাঁই হয় বটে কিন্তু মণিহারা ফণী হয়ে সেদিন থেকেই কেষ্টর মাথা যায় বিগড়ে।

বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারকে ফোনে যে ভাষায় অনুব্রত মণ্ডল গালাগালি করেছেন, তার ছড়িয়ে পড়া ‘কল রেকর্ডিং’ শোনা মাত্র কানে আঙুল দিতে বাধ্য যে কোনও ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা। আইসির মা-স্ত্রী তুলে কদর্য গালি বললেও কম বলা হয়। সেই ভাষা এতটাই জঘন্য যে তা উল্লেখ করলেও মামলা খাওয়ার আশঙ্কা। এক কথায় অশালীনতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গেছেন একদা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহভাজন অনুব্রত মণ্ডল। আইসিকে হুমকি ও তাঁর মা-বউকে যৌন হেনস্থার অভিযোগে গন্ডা খানেক মামলা চাপিয়ে অনায়াসে গ্রেফতার করা চলে কেষ্ট মন্ডলকে।
৬৫ বছরের অনুব্রত মণ্ডল যা কান্ড করেছেন, তাতে অনুব্রতকে রক্ষা করার মুখ নেই তৃণমূলের। বরং নিজের মুখ রক্ষা করতে কেষ্টকে শাস্তি দেওয়া ও ছেঁটে ফেলা ছাড়া রাস্তা নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। গরু পাচার করে জেল খেটেছেন। তবে বালি-পাথর পাচার, খুন-খারাবির অভিযোগ এমনকি পুলিশকে প্রকাশ্যে বোমা মারার হুমকি দিয়েও পার পেয়ে গেছেন অনুব্রত মণ্ডল। কিন্তু ক্ষমা চেয়েও এ যাত্রা অনুব্রত পার পাবেন কিনা সন্দেহ। ইতিমধ্যেই ভারতীয় ন্যায় সংহিতার চারটি ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। তার মধ্যে একটি ধারা (৭৫) শ্লীলতাহানি ও যৌন হেনস্থার।
শনিবার বেলা ১১টার মধ্যে অনুব্রত মণ্ডলকে বোলপুর এসডিপিও অফিসে হাজিরা দিতে নির্দেশ দিয়েছিল পুলিশ। নিজে হাজির না হয়ে আইনজীবী মারফত অনুব্রত জানিয়েছেন, তিনি অসুস্থ, তাঁকে সময় দেওয়া হোক। পুলিশ অনুব্রতকে ২৪ ঘন্টার বেশি সময় দেয় নি। রবিবার দুপুর ১২টার মধ্যে এসডিপিও অফিসে হাজিরা দিতে বলে দ্বিতীয় নোটিশটি অনুব্রতের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে পুলিশ। এখন দ্বিতীয় নির্দেশও উপেক্ষা করলে অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে পুলিশ কী ব্যবস্থা নেয়, তাই দেখার। বোলপুর, সিউড়ি, সাঁইথিয়া ও রামপুরহাট থানায় অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কটাক্ষ, “অনুব্রতের কিচ্ছু হবে না। ও জামিন পেয়ে যাবে। পুলিশ লঘু মামলা দায়ের করেছে। উল্টে দেখবেন, আইসিকেই সাসপেন্ড করা হয়েছে।”

অনুব্রত মণ্ডল যদি রবিবার গ্রেফতার হন, বুঝতে হবে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষস্থান থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পরেই পুলিশ এই পদক্ষেপ করেছে। তবে আইসির মা-বউকে বলাৎকারের হুমকি দিয়ে কেষ্ট গ্রেফতার হন আর নাই হন, কেষ্টর রাজনৈতিক জীবন কিন্তু চরম বিপদে। কেষ্টর অতীতের সব কীর্তিকে ছাপিয়ে গেছে এই ঘটনা। স্নেহভাজন কেষ্ট এখন বোঝা। তার দায় ঝেড়ে ফেলতে পারলেই বাঁচেন মমতা। কেষ্ট যখন পৃথিবীতে থাকবে না, তখনও কেষ্টর বেলাগাম খিস্তি-খেউড় তাঁর স্মৃতিকে কলুষিত করবে যেমন করে চলেছে প্রয়াত তাপস পালকে। বোলপুরের নাগরিক সমাজের উচিত অনুব্রত মণ্ডলকে রবীন্দ্রনাথের শহর ছেড়ে চলে যেতে বলা।
Feature image is representational and created by AI.