পরমার্থের মেলা হলেও যেখানেই মানুষের সমাগম সেখানেই অর্থের আগমন। মহাকুম্ভ ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই তাজা যোগীরাজ্যের বাজার। রাজনৈতিক আকচাআকচি ও যাবতীয় বিতর্ক ছাপিয়ে মহাকুম্ভ কেন অনবদ্য, অসাধারণ, জানাচ্ছেন নব্যেন্দু মৌলিক। পড়ুন শেষ পর্ব-
যে আয়োজনে ৬০ কোটির বেশি মানুষ সামিল হয়েছেন, তার সাথে অর্থনীতির যোগাযোগ থাকবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কুম্ভমেলার সাথে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব আয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক আছে। উত্তরপ্রদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী “মহাকুম্ভ ২০২৫” আয়োজনের জন্য খরচ হয়েছে ৭৫০০ কোটি টাকা। এরমধ্যে ঘাট নির্মাণ, মেলা প্রাঙ্গণ নির্মান, সৌন্দর্যায়ন, নিরাপত্তার ব্যবস্থা, পিপপুলের নির্মান, শৌচাগার নির্মান, গঙ্গাবক্ষে দূষণ নিয়ন্ত্রণ, ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থাপনা, অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল, সড়ক নির্মান থেকে শুরু করে পার্কিং লটের জন্য অধিগৃহীত চাষের জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ সবকিছুই সামিল। উত্তরপ্রদেশ সরকারের মতে ৭৫০০ কোটি টাকা খরচ হলেও এই মেলায় ব্যবসা হবে ২ লক্ষ কোটি টাকার।
পরমার্থ লাভের মহাকুম্ভে কতভাবে অর্থ লাভ!
বহু মানুষ এই পরিসংখ্যান নিয়ে উপহাস করলেও, আমার তো মনে হয় এই রোজগার ২ লক্ষ কোটি টাকাকেও ছাপিয়ে যাবে। এমন বহু রোজগার হয়েছে, যার পরিমাপ সরকার করতেই পারবে না। সরকার তার রোজগারের পরিমাপ করে বৈধ আয় থেকে; যে আয়ের উপর সরকার কর বা রাজস্ব পায়। কিন্তু যে আয় কেউ জানতেই পারল না, তার পরিসংখ্যান তৈরি করবে কে! এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই কুম্ভমেলা বহু মানুষের হাতে কাঁচা টাকার জোগান দিয়েছে। চাঙ্গা হয়েছে উত্তরপ্রদেশের অর্থনীতি। বলা ভাল, উত্তরপ্রদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপর একটি দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব আসবে এর ফলে। কিন্তু এ’বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই কুম্ভমেলার থেকে যে কাঁচা অর্থ সাধারণ জনগণ আয় করলেন, তার পরিমাণ এত বিপুল হলেও, তার থেকে কোনো বৈধ রাজস্ব সরকার পাবে না।
কুম্ভমেলায় উত্তরপ্রদেশ সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার এবং উত্তরপ্রদেশ সংলগ্ন রাজ্যগুলির রাজ্য সরকারের বিপুল আয় হবে টোলট্যাক্স থেকে। এছাড়াও পরোক্ষ করের একটি বড় আয় হবে জিএসটি থেকে। এত মানুষের প্রয়োজনীয় খাবার, জল, ঔষধ, প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি হয়েছে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ গাড়ি এসেছে প্রয়াগরাজে৷ কুম্ভস্নান সেরে জনগণ পাড়ি জমিয়েছেন অযোধ্যা, বারাণসী প্রভৃতি শহরে। ফলে পেট্রোল, ডিজেলের বিক্রি বেড়েছে গোটা দেশজুড়ে। এছাড়াও সাধারণ কেনাবেচা, হোটেল, পরিষেবা সবক্ষেত্র থেকে আয় হয়েছে, ব্যবসা হয়েছে। এমন হয়তো আরও ক্ষেত্র রয়েছে যেখান থেকে বৈধ আয় হয়েছে। এর বাইরেও বাইকে যাতায়াত, টোটো-অটোর যাতায়াত, পার্কিং এর আয়, অস্থায়ী দোকান থেকে বেচা-কেনা, পূজাসামগ্রী বিক্রি করে আয়, চা-এর দোকান, সবমিলিয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে আয়ের সুযোগও পেয়েছেন মানুষ। বাড়িতে, টেন্টে থাকার ব্যবস্থাও করেছেন অনেকে। সেখান থেকেও আয় হয়েছে স্থানীয়দের।

কোভিড পরবর্তী সময়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন সাধারণ মানুষের হাতে কাঁচা টাকার জোগান দিলেই বাজার চাঙ্গা হবে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে। যদিও এটি কোনও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারি উদ্যোগ নয়। এটি একটি ধর্মীয় মহাযজ্ঞ। কিন্তু তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে। ব্যবসায়ীর ব্যবসা বেড়েছে। পরিষেবা প্রদানকারীর আয় বেড়েছে। ঠিক তেমনই কাঁচা অর্থ হাতে পেয়েছে প্রয়াগরাজ, বেনারস ও অযোধ্যার লক্ষ লক্ষ মানুষ। এই কাঁচা টাকা উত্তরপ্রদেশের বাজার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে এবং বেশকিছু দিন তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস।
মহাকুম্ভ ঘিরে রাজনীতি! কে করে নি?
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক দেশে নানা মত, নানা স্বর থাকবে এবিষয়ে কোনও প্রকার সন্দেহ থাকতে পারে না। কুম্ভমেলার মতো ধর্মীয় আয়োজন! যেখানে কোটি কোটি মানুষের সমাগম তা রাজনীতির বাইরে থাকবে তা কখনও হতে পারে না। রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে নিজের দিকের ত্রুটি কেউ খুঁজে পায় না! সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাজনীতির অভিযোগ করে, বিরোধীরা সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাস্তব হলো বাকি সব কিছুর মতোই হিন্দু সনাতনীদের পবিত্র তীর্থ কুম্ভমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজের নিজের মতো করে রুটি সেঁকছে, এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কেন্দ্রের ও উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার বহুদিন আগে থেকেই হিন্দু ধর্মের পেটেন্ট ক্রয় করেছে দেশজুড়ে। এর অন্যথা মহাকুম্ভেও হয়নি। মহাকুম্ভ ২০২৫ কে রাষ্ট্রীয়স্তরে সনাতনীদের তীর্থের বদলে বিজেপির তীর্থ, বলা ভাল, মোদি-যোগীর তীর্থে পরিণত করার চেষ্টা অনেক বেশি প্রতীয়মান হয়েছে। ২০২৪ এর লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশ সহ হিন্দি বলয়ে যে ভরাডুবি বিজেপির হয়েছে, সেই ড্যামেজ কন্ট্রোলে মহাকুম্ভের ষোলোয়ানা ব্যবহার করলেন মোদি-যোগী, এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যোগী শাসিত উত্তরপ্রদেশের পড়শী রাজ্য বিহারে বছর শেষেই বিধানসভার ভোট। ভোটমুখী বিহারে এর বিরাট প্রভাব পড়বে এবং তার ফসল বিজেপি ঘরে তুলবে তা এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সাধু সন্ত থেকে শুরু করে নাগা সন্ন্যাসী, সকলের প্রচারের আলো কেড়ে নিয়েছেন যে দু’জন, তারা হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। সাধু সন্ত সমাজের পক্ষ থেকেও এই কাজে যোগ্য সহযোগিতা করা হয়েছে।

মৌনী অমাবস্যার রাতে পদপিষ্টের যে ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছিল, তা চাপা দিতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি করে নি উত্তরপ্রদেশ সরকার। ঘটনার ইমপ্যাক্ট ধামাচাপা দিতে যোগ্য সঙ্গত ছিল সাধু সন্তদের। যারা প্রয়াত হয়েছেন তাদের সকলের মোক্ষ প্রাপ্তি হয়েছে, এই ধরণের জঘন্য বয়ান এসেছে মধ্যপ্রদেশের বাগেশ্বর ধামের প্রধান ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ শাস্ত্রীর থেকে। যারা কুম্ভে আসবেন না তারা দেশদ্রোহী এমন শব্দও শোনা গিয়েছে তার মুখে। যোগী আদিত্যনাথ নিজে হিন্দু কট্টরপন্থীদের খুশি করতে কুম্ভমেলায় অন্য ধর্মের লোকেদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে মেরুকরণে আরও ধোঁয়া দিয়েছেন। যদিও বাস্তবে মেলা ছিল মিলনমেলা। সব ধর্মের মানুষই, এমনকি বহু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষও এই মেলায় সামিল হয়েছেন। কিন্তু বিপদের কথা চিন্তা করে অনেকেই নিজেদের নাম পরিচয় সামনে আনেননি। মেলা চত্বর জুড়ে যোগী এবং মোদির ছবির ছড়াছড়ি চোখে পড়েছে। কুম্ভমেলাকে আলাদা করে এই দুই ব্যাক্তির মেলা, এটা বোঝানোর চেষ্টা থাকলেও তা যে বিরাট কাজে এসেছে তা নয়। মানুষ রাজনীতি করতে নয়, আধ্যাত্মিকতার টানেই এই মেলায় সামিল হয়েছিলেন।

রাজনীতি করায় বিরোধীরাও যে পিছিয়ে ছিল এমন নয়। দেশের প্রধান বিরোধীদল শতাব্দী প্রাচীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খার্গে থেকে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী মহাকুম্ভের গুরুত্বকেই নস্যাৎ করেছেন। কিন্তু তারা ভুলে গেলেন ভারতের মন পেতে হলে ভারতীয়দের আস্থার প্রতি কটূকথা বলা বোকামি। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর মতো ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারবাদী মানুষ ভারতীয় রাজনীতিতে বিরল। ১৯৫৪ সালে আয়োজিত মহাকুম্ভে তিনিও পুণ্যস্নানে সামিল হয়েছিলেন। স্নান করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং তৎকালীন কংগ্রেস শাসিত উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থও। এরা সকলেই বোকা আর বর্তমান কংগ্রেস নেতৃত্ব খুব চালাক এটা ভাবলে ভুল হবে। নেহেরু জানতেন ভারতের সাধারণ জনগণ কীসে বিশ্বাস করে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসকে সংবেদনশীলতার সঙ্গে ‘ডিল’ না করতে শিখলে নির্বাচনের পর নির্বাচনে লজেন্জই চুষতে হবে কংগ্রেসকে, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কুম্ভের ব্যবস্থাপনার ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে সমালোচনা এক কথা। আর মহাকুম্ভের গুরুত্বকে তাচ্ছিল্য করে বয়ানবাজি আরেক কথা। এবং এই হঠকারিতার ফল ইভিএম খোলার পর টের পাওয়া যাবে।
শুধুমাত্র কংগ্রেস নয়, বেহিসেবী বয়ানবাজি করে রাজনীতির পালে হাওয়া তুলেছেন উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সমাজবাদী পার্টি প্রধান অখিলেশ যাদবও। নিজে যাবতীয় ভিআইপি ব্যবস্থাপনায় পুণ্যস্নান করে, সরকারের ভিআইপি ব্যবস্থাপনাকে খোঁচা দিয়েছেন। পদপৃষ্টে মৃত্যুর ঘটনার সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে সরগরম থেকেছেন তিনি এবং যোগী আদিত্যনাথ। আরজেডি সুপ্রিমো তথা বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব তো মহাকুম্ভকে একেবারে “ফালতু” বলে ফুৎকারে উড়িয়েই দিয়েছেন। আসন্ন বিহার বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির সাথে সরাসরি আরজেডির লড়াই। জেডি(ইউ) বা কংগ্রেস দুধভাত। এই ‘ফালতু’ মন্তব্য বিহারের ধর্মপ্রাণ সনাতনীদের কাছে কতটা প্রাসঙ্গিক হবে তার উত্তর সময় বলবে।
বাদ যাননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তার চিরাচরিত অভ্যাস মতোই মহাকুম্ভকে নতুন নামকরণ করে “মৃত্যুকুম্ভ” নামে সম্বধিত করেছেন তিনি। এদের মধ্যে রাজনৈতিক ভাবে সবচেয়ে কমফোর্টেবল জায়গায় রয়েছেন বাংলার দিদিই৷ কারণ, তার “মৃত্যুকুম্ভ” শব্দ কানে বাজলেও, বহু বাঙালি কিন্তু তার সাথে একমত। একথা বললেও অত্যুক্তি হবে না, গঙ্গাসাগর মেলা ( যদিও তা কুম্ভের জনসমাগমের তুলনায় অনেক কম) আয়োজনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত প্রশংসার দাবী রাখে। ফলে তার মন্তব্য অবশ্যই গুরুত্ব পাবে। “মৃত্যুকুম্ভ” মন্তব্য নিয়ে বিজেপি রাজনৈতিক মেরুকরণের চেষ্টা করলেও মমতা ব্যানার্জির ব্যাটিংয়ের কাছে তা ফুৎকারে উড়ে যাবে বলেই মনে হয়।
মহাকুম্ভ ঘিরে তিন বড় বিতর্ক
মহাকুম্ভে যে তিনটি বিষয় সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তার প্রথমটি, মৌনী অমাবস্যার রাতে “ভাগদর” (পদপৃষ্ট)। সেখানে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে উত্তরপ্রদেশ সরকার দাবি করলেও বিরোধীদের দাবি, মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। বিরোধিদের অভিযোগ, মৃতদেহ ট্রাক্টরে চাপিয়ে গঙ্গাবক্ষে নিয়ে গিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের সত্য মিথ্যা আদৌও জানা যাবে বলে মনে হয় না। উত্তরপ্রদেশ সরকার বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে এবং কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু তাতে বিতর্ক কমার নাম নেই। প্রয়াগরাজের ওলিতে গলিতে কান পাতলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, বিরোধিদের অভিযোগ হয়তো সম্পূর্ণ মিথ্যা নাও হতে পারে। যদিও এই গোটা বিষয়টিই তদন্ত সাপেক্ষ, এবিষয়ে কোনও সন্দহ নেই।



দ্বিতীয়ত, ১৪৪ বছর পর আয়োজিত মহাকুম্ভ। স্বয়ং জ্যোতির্মঠের শঙ্করাচার্য বলেছেন, ১৪৪ বছরের কোনো মাহাত্ম্য নেই। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক গিমিক। শঙ্করাচার্য ছাড়াও রাজনৈতিকভাবেও ১৪৪ বছরের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই আবহেই ভাইরাল হয়েছে তিনটি পেপার কাটিং। একটি নিউ লন্ডন পত্রিকার, ৩রা ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪-র পেপার কাটিং। যেখানে দেখা যাচ্ছে ১৯৫৪ সালের মহাকুম্ভকে ১৪৪ বছর পর হওয়া মহাকুম্ভ বলে দাবী করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই কুম্ভেই স্নান করেছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। এরপর ১৯৭৭ সালের ৭ই জানুয়ারিতে “দি এজ” পত্রিকার একটি পেপার কাটিং-এ ১৯৭৭ সালে হওয়া কুম্ভকে ১৪৪ বছর পর আয়োজিত মহাকুম্ভ বলা হয়েছে। একইভাবে “দি ইউনিয়ন ডেমোক্র্যাট” পত্রিকায় ২৬ শে জানুয়ারি, ২০০১ সালের পেপার কাটিং-এ ২০০১ সালের কুম্ভকে ১৪৪ বছর পর আয়োজিত মহাকুম্ভ বলে দাবি করা হয়েছে। আবার ২০২৫ সালের মহাকুম্ভও নাকি ১৪৪ বছর পর হচ্ছে। এই বিতর্কের যবনিকা পতন ঘটিয়েছেন জ্যোতির্মঠের শঙ্করাচার্য। তিনি জানিয়েছেন কুম্ভের সাথে ১৪৪ বছরের কোনো সম্পর্ক নেই। ৩ বছরে কুম্ভ, ৬ বছরে অর্ধকুম্ভ, ১২ বছরে পূর্ণকুম্ভ হয়। এমনকি তার দাবি কুম্ভের যোগ মাসের পর মাস ধরে চলে না। কুম্ভের যোগ শুধুমাত্র মৌনী অমাবস্যার দিনেই তৈরি হয়। যেদিন সূর্য চন্দ্র বৃহস্পতির বিশেষ যোগ তৈরি হয়। এটি ১২ বছর অন্তর হয়। সুতরাং, ১৪৪ বছরের যুক্তিকে সম্পূর্ণ অসাড় দাবী করেছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে বিতর্ক সহজে মিটবে বলে মনে হয় না।
তৃতীয়ত, নদী দূষণের অভিযোগ প্রথম থেকেই উঠছিল কুম্ভস্নানকে কেন্দ্র করে। সমাজবাদী পার্টির রাজ্যসভা সাংসদ অভিনেত্রী জয়া বচ্চন সবার আগে অভিযোগ করেছিলেন, কুম্ভস্নানে দূষিত হয়েছে গঙ্গার জল। এমনকি গঙ্গাজলে মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়ার অভিযোগও করেছিলেন তিনি। এর পরেই আসরে নামার সুযোগ পেলেন সবাই। জাতীয় পরিবেশ আদালতে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের জমা করা একটি রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই চক্ষুচড়ক গাছ সকলের। কুম্ভের জলে কলিফর্ম (মানুষ ও প্রাণীর মলমূত্রের জীবাণু) এর উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। মলমূত্রের ব্যক্টেরিয়া মিশে নদীর জল দূষিত হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ এই জলে স্নান করায় রোগ ছড়িয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করেন বিজ্ঞানীরা। জাতীয় পরিবেশ আদালতের পর্যবেক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ উত্তরপ্রদেশ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। জাতীয় পরিবেশ আদালত উত্তরপ্রদেশ সরকারের ব্যাখ্যা তলব করেছে। এই পর্যবেক্ষণ গঙ্গাদূষণ নিয়ন্ত্রণে কতটা কাজে আসবে জানা নেই। তবে রাজনীতিতে নতুন অস্ত্র তৈরি করেছে এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিরোধীরা একযোগে বিঁধেছে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে। আক্রমণ শানিয়েছেন জ্যোতির্মঠের শঙ্করাচার্যও। উলটে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ কেন্দ্রের রিপোর্টকে নস্যাৎ করে জানিয়েছেন ত্রিবেণী সঙ্গমের জল পানেরও যোগ্য। নেটিজনেরা অবশ্য যোগীজিকে প্রকাশ্যে জলপানের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ইতিমধ্যেই মহাকুম্ভ শেষ হয়েছে। কিন্তু তার উত্তর এখনও অধরা। “মহাকুম্ভ ২০২৫” নিঃসন্দেহে আস্থা, ভক্তি ও বিশ্বাসের মহোৎসব হয়ে উঠেছিল। বিস্ময় সৃষ্টিকারী এই আধ্যাত্মিক সমাবেশকে ঘিরে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আকচাআকচি এবং অকারণ বিতর্ক অনভিপ্রেত।
‘সবার মধ্যেই আমি’, কুম্ভস্নানে এই উপলব্ধির মধ্যেই অমৃত লাভ
অমৃত কি! এবিষয়ে আলোচনার শেষ নেই। সমুদ্র মন্থনের একেবারে শেষে ধন্বন্তরি “অমৃত কলস” বা “অমৃত কুম্ভ” হাতে নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন৷ যে অমৃতের অধিকার নিয়ে যুদ্ধ হয়েছিল দেবতা ও অসুরদের। অমৃতের ভাগ পেতে দেবতারা ছুটলেন ভগবান বিষ্ণুর কাছে। এরমধ্যে পক্ষীরাজ গড়ুর, মতান্তরে ইন্দ্রপুত্র জয়ন্ত অমৃত কলস নিয়ে উড়াল দিলেন। উড়ার সময় কলস থেকে ১২ ফোঁটা অমৃত চলকে পড়লো নিচে। যার ৮ ফোঁটা পড়লো পৃথিবীর বাইরে, এবং ৪ ফোঁটা পড়লো পৃথিবীতে, হরিদ্বারে, প্রয়াগে, নাসিকে, উজ্জিয়িনীতে।
আর এই অমৃতের পবিত্রতায় পবিত্র হলো গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, গোদাবরী এবং শিপ্রা নদী৷ প্রচলিত বিশ্বাস, এই নদীগুলিতে প্রতি তিন, ছয় এবং ১২ বছর অন্তর গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে বিশেষ যোগ তৈরি হয়। সেই যোগে স্নান করলে অমৃত লাভ হয়। পুণ্য হয়। কিন্তু এই অমৃত কি! আদৌও কি তার খোঁজ নিতে প্রচেষ্টা করি আমরা! করি না। এমনকি যে কোটি কোটি মানুষ কুম্ভস্নান করলেন তারাও কি অমৃতের স্বরূপ জানেন! জানেন না। অনেক বিশ্লেষকের মতে, অমৃত মহাষৌধি। যা নিরোগ করে দেবতাদের অমরত্ব দান করেছে। এক্ষেত্রে ধন্বন্তরির সাথে চিকিৎসক শব্দের যোগ দেখিয়ে বাঙালি গবেষকদের দাবী “ধন্বন্তরি চিকিৎসক” শব্দটির উৎপত্তি এখান থেকেই।
এ জগতে কেউ অমর নন। অমরত্বের প্রাপ্তি অসম্ভব। “জন্মালে মরতে হবে”, এ হল জীবনের সার সত্য৷ কোনও ঔষধী বা মহাষৌধী কাউকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। আর পাপ শোধন! গীতার চেয়ে বড় শাস্ত্র হিন্দুদের জন্য আর কী আছে! যা জীবনের সার বাস্তবকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ঈশ্বর কাউকে পাপ দেন না। ইশ্বর কাউকে পুণ্যও দেন না। নিজের কর্মফলেই মানুষ পাপ ও পুণ্য সঞ্চয় করে। আর সেই পাপের ফল বা পুণ্যফল তাকে জীবদ্দশাতেই ভোগ করতে হয়৷ এই নিয়মের বাইরে কেউ নয়।
সশরীরে স্বর্গারোহন বা মোক্ষলাভ পুরাণে একমাত্র পাণ্ডুপুত্র ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের হয়েছে। তাও বহু কাঠখড় পুড়িয়ে। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যিনি ভগবান বিষ্ণুর অবতার তাকেও গান্ধারীর অভিশাপ ভোগ করতে হয়েছে। ব্যাধের বানে বিদ্ধ হয়ে যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তাহলে আমাদের জন্য, জাগতিক মানুষের জন্য নিয়ম পৃথক হবে এই ভাবনা আসে কোথা থেকে। কুম্ভস্নানেই পাপ যাবে এটা শুধু কষ্টকল্পনাই নয়, চূড়ান্ত হাস্যকরও বটে।
তাহলে এত মানুষকি শুধুই হুজুগে মেতে তীর্থরাজ প্রয়াগে স্নান করলেন? একদমই নয়। তারা এসেছেন ধর্মের টানে। যেই ধর্ম আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেই ধর্ম আমাদের জীবন পরিচালনা করতে শেখায়। কোটি কোটি মানুষের সবাই পাপ ধুতে মহাকুম্ভে গিয়েছে, এই কথা যারা বলছেন, তারা কি এটা জানেন- মানুষ মাত্রেই নিজেকে পাপি বলে মনে করে না। সবাই নিজেকে পাপি ভাবে না। সনাতন ধর্মে নরের মধ্যেই নারায়ণের বাস। এমনকি জীব মাত্রেই ব্রহ্মের অংশ। কাজেই পাপমোচন বড় কথা নয়। বড় কথা, আমি যে এক ও অভেদের অংশ, এটা উপলব্ধি করতে পারা।
তাহলে আমাদের জীবনে মহাকুম্ভের মতো আধ্যাত্মিক উৎসবের গুরুত্ব কোথায়? আসলে কুম্ভের জলে, ত্রিবেণীর বহমান ধারায়, সাধু সন্তদের নিরহংকারী জীবন যাপনে, জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে সকল মিলনতীর্থে মানুষ ছোট আমিত্বের উপরে উঠে বড় আমিত্বের স্বাদ পায়। ‘সকলকে নিয়েই আমি’, সকলের মধ্যেই আমি’- কুম্ভে যাওয়ার পর আপনার এই উপলব্ধি না হলে আপনার কুম্ভস্নান বৃথা। অমৃতের সন্তান মানুষ। আর মানুষের মহাসাগর, মানুষের মহাসঙ্গমের নামই কুম্ভমেলা। মানুষের মহাসাগরে অবগাহন করে বৃহতের মাঝে নিজেকে বিলীন করে দেওয়াই প্রকৃত অমৃত লাভ।