বিশেষ প্রতিবেদন: তিনি অসুস্থ হয়ে রবিবার মুম্বাইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক মাধ্যমে। সোমবার জানা গিয়েছিল ৮৭ বছরের রতন টাটার শারীরিক অবস্থা নিয়ে আশঙ্কিত হওয়ার তেমন কোনও কারণ নেই। বুধবার রাতে সেই হাসপাতাল থেকেই এল দুঃসংবাদ- মহীরুহের পতন হয়েছে। ভারতের শিল্প-বাণিজ্য জগতের অন্যতম কর্ণধার রতন নাভাল টাটা আর নেই। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুম্বাইয়ের এক পার্সি পরিবারে রতন টাটার জন্ম। রতনের বাবা নভল হরমুসজিকে দত্তক নিয়েছিলেন রতনজি জামসেতজি টাটা। রতনের যখন দশ বছর বয়স, তখনই তাঁর বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হয়। রতনকে গড়েপিটে মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রতনজি জামসেতজি টাটার সহধর্মিণী নাভাজবাই টাটা। রতন টাটাকেও আইনিভাবে দত্তক নিয়ে টাটা পরিবারের একজন সদস্য করে নেন নাভাজবাই। কার্যত রতনের মায়ের ভূমিকা নিয়েছিলেন নাভাজ। রতন টাটার প্রাথমিক শিক্ষা মুম্বাইয়ের ক্যাম্পিয়ন স্কুলে। এরপর ক্যাথিড্রাল অ্যান্ড জন কেনন স্কুল হয়ে শিমলার বিশপ কটন স্কুল এবং সেখানকার পাঠ শেষ করে আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে নিউ ইয়র্কের রিভারডেল কান্ট্রি স্কুলে ভর্তি হন রতন টাটা। ১৯৫৫ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আমেরিকার বিখ্যাত কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে স্থাপত্যবিদ্যায় ভর্তি হন তিনি। ১৯৫৬ সালে এখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন রতন টাটা।
মানুষটার ব্যক্তিত্ব ছিল অন্য রকম। কোনও রকমের দেখনদারি ছিল না। কখনও প্রাচুর্যের অহঙ্কার দেখাতেন না। রুচি ও মূল্যবোধে আভিজাত্য ছিল নিঃসন্দেহে কিন্তু দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার হয়েও জীবনযাপন ছিল বিলাসিতাহীন। নিজের ভোগের জন্য কখনও টাকা ওড়ান নি রতন টাটা। আসলে অগ্নি উপাসক পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষদের ভেতরে সচরাচর যে পরিমিতি বোধের দেখা মেলে, রতন টাটা তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ব্যক্তিগত জীবনে অকৃতদার রতন টাটার কাছে টাটা গোষ্ঠীটাই ছিল পরিবার। বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ ছিল। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে দফতরে যেতেন। কর্মীদের বিপদে আপদে সবসময় পাশে থাকতেন। স্নেহশীল পিতার মতোই সবাইকে আগলে রাখতেন। টিম লিডার বা অধিনায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন অনবদ্য। বিনিয়োগ ও ব্যবসার বাইরে সমাজ ও পরিবেশ নিয়েও ভাবতেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের একটা ঐতিহ্য আছে টাটা গোষ্ঠীর। টাটার সামাজিক দায়বদ্ধতার নীতিকে আরও বিস্তৃত করেছিলেন রতন টাটা।
১৯৯১ সালে জেআরডি টাটা চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসর নিলে টাটা গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন রতন টাটা। ভারতে উদারীকরণ শুরু হলে রতন টাটার হাত ধরে শিল্প-বাণিজ্যের নতুন নতুন ক্ষেত্রে পা রাখতে শুরু করে টাটা গোষ্ঠী। রতন টাটা চেয়ারম্যান ও এমডি হিসেবে সংস্থার দায়িত্ব নেওয়ার দশ বছরের মধ্যে ৩২ টি নতুন কোম্পানি খোলে টাটা গোষ্ঠী। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও টাটাদের বিনিয়োগ শুরু হয় রতন টাটার নেতৃত্বে। কোনও সন্দেহ নেই যে, রতন টাটা দায়িত্ব নেয়ার অনেক আগে থেকেই ভারতীয়দের কাছে টাটা আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক; তবে রতন টাটার সুযোগ্য পরিচালনায় ভারতের টাটা যথার্থ বহুজাতিক কোম্পানি হয়ে উঠেছিল। যাকে বলে ‘আনমল রতন’, রতন টাটা ছিলেন তাই। শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী আগামীর ভারত রতন টাটাকে মনে রাখবে।