আরজি কর কান্ড: সন্দীপ ঘোষ কি শুধু তথ্যপ্রমাণ‌ই লোপাট করেছেন নাকি তাঁর ভূমিকা আরও ভয়ঙ্কর?

আরজি কর কান্ড: সন্দীপ ঘোষ কি শুধু তথ্যপ্রমাণ‌ই লোপাট করেছেন নাকি তাঁর ভূমিকা আরও ভয়ঙ্কর?


আরজি করে ‘পিজিটি’ ধর্ষিত ও খুন! ধৃত সঞ্জয়কে ধনঞ্জয় বানানোর ‘প্রোজেক্ট’ হয়তো ভেস্তে যেতে বসেছে। কিন্তু আসল অপরাধী কে বা কারা? রহস্য বড়ই জটিল। সিবিআই কিনারা করতে পারবে তো? বিশ্লেষণে ঋতুপর্ণা কোলে-

শুরুটা তাহলেই শুরু থেকেই করা যাক। ৯ আগস্ট দুপুর ১টা নাগাদ জুনিয়র ডাক্তার ভাই মেসেজ করলো, আরজি করে এক PGT-কে খুন করে ধর্ষণ করা হয়েছে। মেসেজটা ফরোয়ার্ডেড ছিলো। স্বাভাবিক প্রশ্ন ছিলো, কে করেছে কিছু জানা গেছে? তাতে লিখল, “না, এদিকে প্রিন্সিপালের বক্তব্য শুনবে?” বলেই আবার একটা ফরোয়ার্ডেড মেসেজ, Principal’s statement- “Was irresponsible of the girl to be alone at night” এটুকু দেখে পরের মেসেজটা আমার ছিলো- “এ তো পোটেনশিয়াল রেপিস্ট …… এ নিজেই করেছে কিনা দেখ”।

৯ তারিখ দুপুর আড়াইটায় বলা কথাটা ছিল উল্লেখিত স্টেটমেন্টের প্রেক্ষিতে করা নিতান্তই একটা ‘ক্যাজুয়াল’ কথা। আজ এই লেখাটা যখন লিখছি তখন ঘড়িতে বাজছে দুপুর ১২.২০, তারিখ ১৭ই সেপ্টেম্বর। সামনে টিভিতে চলছে সুপ্রিম কোর্টের শুনানি। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমার মনে কোথাও যেন এই সন্দেহ রীতিমতো দৃঢ় হয়েছে যে , “এ নিজেই করেছে কিনা দেখ”। কিন্তু তারপরেও আরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। সে সব প্রশ্নে যাওয়ার আগে দেখে নিই বারবার সন্দেহের তীর কেন সন্দীপ ঘোষের কাছে গিয়ে আটকে যায়।

সন্দীপ ঘোষ, আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ। বর্তমানে দুর্নীতি ও খুন-ধর্ষণের ঘটনায় প্রমাণ লোপাটের জন্য জেলবন্দী। এখনও খুনি ও ধর্ষকের সঠিক সন্ধান পাওয়া যায় নি। যে সিভিক পুলিশকে ধরা হয়েছে সে ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ তিলোত্তমার হত্যায় একাধিক ব্যক্তির জড়িত থাকার কথা বারে বারে আসছে। তদন্ত চলবে… কিন্তু আজ চিনে নিই সন্দীপ ঘোষকে।

বনগাঁর বাসিন্দা সন্দীপ ঘোষ রামকৃষ্ণ মিশন থেকে মাধ্যমিক দেবার পর উচ্চমাধ্যমিক দেন বনগাঁ হাই স্কুল থেকে। পড়াশোনায় ভাল হবার কারণে শিক্ষকদের চোখের মণি সন্দীপ সম্পর্কে তাঁর সহপাঠীদের বক্তব্যগুলি এক এক করে জেনে নিই-

সন্দীপের স্কুল সহপাঠী তথা আন্তর্জাতিক একটি কনসালটেন্সি সংস্থার সিইও অরিন্দম ঘোষ আনন্দবাজার পত্রিকাকে জানিয়েছেন, ‘‘ছাত্রাবস্থায় সন্দীপ কারও সঙ্গে মিশতে চাইত না। ও চাইত, শিক্ষকেরা কেবল ওর প্রশংসা করুন”। (সূত্র- আনন্দবাজার ২০.০৮.২৪)

আরেক সহপাঠী তন্ময়ের কথায়, ‘‘সন্দীপ খুব আত্মকেন্দ্রিক ছিল। নিজের গ্রুপের বাইরে কারও সঙ্গেই মিশত না। পড়াশোনায় ভাল ছিল। তবে পড়াশোনার ব্যাপারে কারও সঙ্গে কিছু আলোচনা করত না।’’ (সূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা ২০.০৮.২৪)

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সহপাঠী বলেন, ‘স্কুলে ভাল আবৃত্তি করত। কিন্তু অন্য কেউ ভালো আবৃত্তি করলে বা স্যারদের প্রশংসা পেলে তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিত। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কিছু শেয়ার করত না। বাড়িতে বন্ধুরা গেলে তাদের পড়ার ঘরে ঢুকতেও দিত না।’ আরও এক সহপাঠী বলেন, ‘খুবই আত্মকেন্দ্রিক ছিল সন্দীপ। চিকিৎসক হওয়ার পর রোগী ভর্তি করাতে গিয়ে ওর কোনও সাহায্য পাইনি।’ (সূত্র- বর্তমান পত্রিকা ২০.০৮.২৪)

মধ্যে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হ‌ওয়ার পর।

আমরা সকলেই জানি বর্তমানে সিবিআই তথ্য প্রমাণ লোপাটের জন্য সন্দীপ ঘোষকে গ্রেফতার করেছেন। সন্দীপের সহপাঠীদের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার যে সন্দীপ ছিলেন চরম আত্মকেন্দ্রিক। সেই মানুষটি সামান্য একজন সিভিক পুলিশকে বাঁচাতে নিজেকে এতটা নিংড়ে দেবে ভাবতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। তথ্যপ্রমাণ লোপাটের জন্য তিনি কী কী করেছেন সে প্রশ্নে আসব। সহপাঠীদের পাশাপাশি সন্দীপ ঘোষের পাড়া প্রতিবেশী ওঁর সম্পর্কে কী বলছে এখন জেনে নিই-

সন্দীপ ঘোষের কর্মকাণ্ড ঘিরে বিতর্ক রয়েছে বারাসতেও। অভিযোগ, বারাসতের মল্লিক বাগানে থাকাকালীন সদ‍্য মা হওয়া নিজের স্ত্রীর পেটে লাথি মেরেছিলেন এই অর্থোপেডিক চিকিৎসক । সেসময় সন্দীপের হাত থেকে স্ত্রীকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন পাড়া প্রতিবেশীরাই। এরপর এক কাপড়ে স্বামীর সংসার ছেড়ে ১৪ দিনের সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে বাধ‍্য হন সন্দীপের স্ত্রী। আরজি করের প্রাক্তন অধ‍্যক্ষ’র চরম শাস্তি চান সন্দীপের একসময়ের প্রতিবেশীরা। তাঁদের কথায়, “সন্দীপ ঘোষ অমানুষ, একজন নোংরা লোক৷” (সূত্র- ETV Bharat ০৮.০৯.২৪)

সন্দীপের খুনী মানসিকতা এটুকুতেই থেমে নেই। তার কর্মকাণ্ড সমাজে একপ্রকার জীবাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিতে পারে। সংবাদ প্রতিদিনের খবর অনুযায়ী, “আর জি কর হাসপাতাল থেকে বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য পাচারে সিবিআইয়ের হাতে উঠে এসেছে ‘বাংলাদেশি রবি’র নাম। এই বাংলাদেশি রবি ও পঞ্চুর মতো কয়েকজনের হাত ধরেই আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের মদতে হাসপাতাল থেকে বর্জ্য বাইরে পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ পেয়েছে সিবিআই”। (সূত্র-সংবাদ প্রতিদিন ১২.০৯.২৪)

আত্মকেন্দ্রিকতা তো ছিলোই তারসঙ্গে ছিলো পাশবিক খুনি প্রবৃত্তি। সদ্য সন্তান জন্ম দেওয়া নিজের স্ত্রীর পেটে লাথি মেরে যে ব্যক্তি সেলাই ফাটিয়ে দিতে পারে সেই ব্যক্তি পারে না এমন কোনো নারকীয় কাজ আছে বলে আমি মনে করি না। বায়োমেডিকেল বর্জ্য পাচার তারই প্রমাণ। খুনি প্রবৃত্তি থাকলেই যে ধর্ষক মানসিকতা থাকবে তা নাও হতে পারে। সেকারণে স্কুল, পরিবার, প্রতিবেশি ছাড়িয়ে এবার আলোকপাত করা যাক কর্মজীবনের আরও কিছু ঘটনার দিকে।

সালটা ২০১৭। মে মাসে তিনি তখন মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান চিকিৎসক। একটি চিকিৎসা-শিক্ষা সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে হংকংয়ের কাউলুন শহরে যান। তাঁর সেই সফর আবার সরকারি অনুমতি ছাড়াই হয়েছিল বলে অভিযোগ। সেখানে এক পুরুষ নার্সের সঙ্গে যৌনতার ইঙ্গিতপূর্ণ অসভ্যতা করার কারণে কিছুদিন কারাবাসও হয়। (সূত্র- এইসময় ০৯.০৯.২৪)

এদিকে নিউজ ১৮ বাংলা-র ক্যামেরায় একজন রূপান্তরকামী অভিযোগ করেছেন, “মুর্শিদাবাদে থাকাকালীন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে রূপান্তরকামীদের অনেকের ফোন নম্বর জোগাড় করতেন সন্দীপ। তারপর তাঁদের ডেকে পাঠাতেন নিজের ডেরায়” । আরও অভিযোগ, সেখানে রূপান্তরকামীদের রীতিমতো যৌন নিগ্রহ করতেন সন্দীপ ঘোষ। শুধু তাই নয়, রাতভর রীতিমতো অত্যাচার চালাতেন সন্দীপ। এমনকী তাঁদের অনেকেই এ কারণে রক্তাক্তও হন বলে অভিযোগ। সেই সমস্ত তথ্য তাঁরা এবার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে চান। (সূত্র- নিউজ 18 বাংলা ১৫.০৯.২৪)

বোঝা গেল, আত্মকেন্দ্রিক, খুনিপ্রবৃত্তির পাশাপাশি বিকৃত যৌন মানসিকতার আধিকারীও ছিলেন এই সন্দীপ ঘোষ। কিন্তু তাঁর এই বিকৃতির নমুনা এখানেই থেমে নেই। মুর্শিদাবাদ থেকে তিনি চলে আসেন কোলকাতা ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজে। সেখানেও নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তাই তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিবারই তাঁকে শাস্তিস্বরূপ সরকার আগের থেকে উঁচু পদ দেন। ২০২১ সালে যোগ দেন আরজিকরে অধ্যক্ষ হিসাবে। এরপর আরজি করে কী কী ঘটে সে সবই টিভির পর্দায় রোজ দেখছেন। সে প্রসঙ্গে যাব না। বিকৃত যৌন মানসিকতার দিকটা কেবল তুলে ধরবো তারজন্য চোখ রাখবো আরজি করের মর্গের দিকে।

নজরবন্দী পত্রিকায় ১১.০৯.২৪ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে-

১) ২০২১ সালে সন্দীপ ঘোষ যোগদান করা পর আরজি করে নতুন হেড ডোম নিযুক্ত করা হয়। আগেরজনকে মুখের কথায় সরিয়ে দেওয়া হয়।

২) ২০২১ সাল থেকে প্রতি বছর ৫০-৬০ টি মৃতদেহের হিসাবের গরমিল পাওয়া যায়।

৩) রাতে মর্গ খুলে মৃতদেহর সঙ্গে চলত সহবাস। করা হত ভিডিও। সেই সব ভিডিও পাওয়া যায় সঞ্জয়ের মোবাইলে। এই সঞ্জয় সামান্য সিভিক পুলিশ হলেও সন্দীপের খুবই ঘনিষ্ঠ।

সন্দীপ নতুন ডোম আনেন, তারপর এসব শুরু হয়। ফলে এই ঘটনার সঙ্গে সন্দীপ যে এই ঘৃণ্য অপরাধে জড়িত তা বলার অবকাশ রাখে না। আশা করা যায় তদন্তকারী দল এদিকেও নজর দেবেন। তবে এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় সিবিআই আধিকারিকেরা তদন্ত করতে গিয়ে সন্দীপের ল্যাপটপে একাধিক পুরুষের নগ্ন ছবি মিলেছে পেয়েছেন বলে খবর।

আত্মকেন্দ্রিক, খুনি প্রবৃত্তিযুক্ত, বিকৃত মানসিকতার সন্দীপ ঘোষকে এবার ৯ তারিখের প্রেক্ষিতে দেখা যাক। প্রথম থেকে তদন্তকারীদের তিনি বলেছিলেন সকাল দশটায় তিনি নাকি তিলোত্তমার মৃত্যুর খবর পান। তিলোত্তমার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে ভোরের দিকে তিলোত্তমার মৃত্যু ঘটেছে। এখানেই একটা সংশয় তৈরী করেছেন সন্দীপের গাড়ির চালক। তাঁর বক্তব্য সরাসরি প্রকাশ্যে না এলেও প্রমাণ করে সেই ভোর রাতে সন্দীপ আরজি করেই ছিলেন বা এসেছিলেন।

এখানে দুটো প্রতিবেদনের অংশ তুলে দিচ্ছি-

১) আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের জন্য বরাদ্দ সরকারি গাড়ির চালককে ফোন করা হয় ভোর বেলা। তড়িঘড়ি হাসপাতালে আসতে বলা হয় তাকে। স্বয়ং সন্দীপ ঘোষ ভোর বেলা ফোন করে ডেকেছিলেন। ( সূত্র- দ্য ওয়াল ০৮-০৯-২৪) তাহলে কি সন্দীপ হসপিটালেই ছিলেন?

২) চালক তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, তাঁকে ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ফোন করা হয়। প্রাক্তন অধ্যক্ষ বলেছিলেন, তাঁকে পিক আপ করতে হবে। সেইমতো পৌঁছে চালক সন্দীপকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। (সূত্র- বর্তমান ১০.০৯.২৪) এই বক্তব্য আরও স্পষ্ট হওয়া দরকার। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কখন সন্দী হসপিটালে আসলেন, কখন ফিরলেন এবং আবার কখন গেলেন?

এরপরের ঘটনা এই হসপিটালে আসার ব্যাপারটিকে আরও রহস্যজনক করে তুলছে। তদন্ত চলাকালীন হঠাৎ-ই তিলোত্তমার দেহ পাওয়া সেমিনার রুমের পাশের ঘর ও শৌচাগার ভাঙা হয়। TV9-এর প্রতিবেদন অনুসারে, “সেমিনার রুম চত্বর ভাঙার নির্দেশ দিয়েছিলেন আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। …নির্দেশনামায় উল্লেখ করা রয়েছে, ১০ অগাস্ট প্ল্যাটিনাম জুবলি বিল্ডিংয়ে যে বৈঠক হয়েছিল, সেখানে স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগম, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা কৌস্তভ নায়েকের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই মতো নির্দেশ দিয়েছিলেন সন্দীপ ঘোষ। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও নির্দেশনামার বয়ান এমনভাবে রয়েছে, যাতে সন্দীপ ঘোষ বন্দুক রাখছেন স্বাস্থ্যভবনের কাঁধেই”। (সূত্র- TV9 বাংলা ০৫.০৯.২৪)

এই খবর প্রকাশের আগেই সিবিআই সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়ে দিয়েছেন “প্লেস অফ অকারেন্স” পরিবর্তন হয়েছে। ফলে সন্দীপ ঘোষের তত্ত্বাবধানে এইসব ভাঙচুর প্রতিবেদনের শুরুতে জাগা প্রশ্নটিকে আবার খুঁচিয়ে দিচ্ছে। এমন খুনে প্রবৃত্তির, বিকৃত যৌন মানসিকতার আত্মকেন্দ্রিক মানুষ কার অপরাধ ঢাকার জন্য এতখানি মরিয়া হবেন? উত্তরে দুটো জিনিস আসতে পারে। প্রথমত, নিজেকে বাঁচাতে, দ্বিতীয়ত, প্রভাবশালী কাউকে বাঁচাতে।

প্রভাবশালীর কথাটা বলছি তার কিছু কারণ অবশ্যই আছে। একজন সিভিক পুলিশকে বাঁচাতে বাংলার স্বাস্থ্য দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র দপ্তর (দুটির মন্ত্রীত্ব কিন্তু একজনের হাতেই) এভাবে কি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে? সেই প্রশ্নের উত্তরে আসতে গেলে শিয়ালদহ আদালতে সিবিআই পক্ষের আইনজীবির করা উক্তিটি খুবই প্রাসঙ্গিক। সেখানে সিবিআই রিপোর্টে স্পষ্ট ভাষায় লেখা হয়েছে, ‘‘চিকিৎসক সন্দীপ ঘোষ সে দিন আইনের সঠিক ধারায় এফআইআর করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অন্য কারও নির্দেশে, বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশীদার হিসাবে এমন কাজ তিনি করছিলেন কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ পাশাপাশি জানা যাচ্ছে সকাল ১০টায় আরজিকরে এলেও সেমিনার রুমে যান নি সন্দীপ ঘোষ। (সূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা ১৭.০৯.২৪)

এই বৃহত্তর ষড়যন্ত্র যত দিন যাচ্ছে তত যেন আস্তে আস্তে নিজেকে মেলে ধরছে। প্রথম দিকে ঘটা কিছু ঘটনা আজ অনেক প্রশ্নকে জাগিয়ে তুলছে। সন্দীপ ঘোষ কেমন মানুষ তা কি রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী কি আদৌ জানতেন না? আখতার আলী প্রমাণসহ সবই তাঁকে লিখে জানিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ আখতার আলিকে আরজি কর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কেন? এই কেনর উত্তর সিবিআই নিশ্চয়ই দেবে।

সন্দীপ ঘোষ রাজ্য সরকারের কাছে কতটা মহার্ঘ তা আরজি কর কান্ডের প্রথম থেকে রাজ্যের মানুষ বুঝে গেছে। একদিকে সঞ্জয়কে ধরার পরে অভিষেক ব্যানার্জি পুলিশকে অনুরোধ করলেন এনকাউন্টার করে ‘কেস ফাইল’ বন্ধ করার জন্য। অভিষেক বলেছিলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা যারা ঘটায় তাদের সমাজে থাকার অধিকার নেই। আপনারা মনে করেন, যারা এই ঘটনা ঘটাল তার বেঁচে থাকার অধিকার আছে? ৭ দিনের মধ্যে এনকাউন্টার করে মারা উচিত দোষীকে।’ (সূত্র-হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা ১১.০৮.২৪)

অন্যদিকে আরজি করের অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিতে ইচ্ছুক সন্দীপ ঘোষকে পুনরায় প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে কোলকাতার আরেক নামকরা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ করে দেয় স্বাস্থ্য দফতর! কার নির্দেশে গুণধর সন্দীপের ‘প্রাইজ পোস্টিং’, বাংলার একটা শিশু‌‌ও তা জানে। যদিও হাইকোর্টের নির্দেশে সন্দীপের সেই পোস্টিং আটকে যায়। কিন্তু রাজ্য সরকার আরজি করে মহিলা চিকিৎসক খুন-ধর্ষিত হ‌ওয়ার পরেও সন্দীপকে ‘রিওয়ার্ড’ দিয়েছিল তো।

আরজি করে ‘অভয়া’কে খুন-ধর্ষণের পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কী বললেন? তিনি বলেন, “যখন ঘটনাটি ঘটে, আমি তখন ঝাড়গ্রামে। সারারাত ঘুমাইনি। রাত ২টো পর্যন্ত বিনীত গোয়েলের সঙ্গে কথা হয়েছে। গত এক মাসের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হয়েছে। কোন অ্যাকশনটা আমরা নিইনি? ১২ ঘণ্টার মধ্যে আসল খুনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে”। (সূত্র- আজকাল ১৪.০৮.২৪)

এখন সিবিআই প্রমাণ লোপাটের জন্য টালা থানার ওসিকে গ্রেফতার করছেন। কিন্তু এটাতো নিশ্চিত সকলেই জানি উপর মহলের চাপ না থাকলে কখনোই নিচুতলার কর্মীরা কিছু করেন না। এই ওসির মাথায় ছিলেন নর্থ ডিসি অভিষেক গুপ্তা। তিলোত্তমার মা বাবার অভি্যোগ এই নর্থ ডিসি ঘটনার দিন তিলোত্তমার মা বাবাকে টাকা দিতে যান। তিনি নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব করবেন না। এই নর্থ ডিসির মাথা হলেন বিনীত গোয়েল, যিনি আরজি করে উপস্থিত ছিলেন। সিবিআই এর বক্তব্য ওসি তথ্যপ্রমাণ লোপাট করেছেন।যেখানে গোয়েল উপস্থিত সেখানে ওসির নিশ্চয়ই নিজের থেকে কিছু করার প্রশ্নই আসে না। আবার বিনীত গোয়েলও তাঁর উপরের আদেশ ছাড়া কিছু করবেন সেটাও অবিশ্বাস্য।

অন্যদিকে পুলিশমন্ত্রীই জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকেই তিনি বিনীতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর ভূমিকার প্রশংসা করতেই হয়। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, যে তদন্তের গতিপ্রকৃতি রাত দুটো অবধি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী দেখেছেন সেই কেসেই তথ্যপ্রমাণ লোপাটের মতো অভিযোগ আসছে কেন? সেই কেসকেই সিবিআই “বৃহত্তর ষড়যন্ত্র” বলে দাগাচ্ছেন কেন? সিবিয়াই এর সেই তদন্ত দেখে সুপ্রিম কোর্ট কেন বলছে, “সিবিআই ঠিক পথেই এগোচ্ছে”? তাহলে কাকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে সেদিন থেকে? সঞ্জয়? সন্দীপ? নাকি খোলা আকাশের তলায় ঘুরছে সেই অপরাধী?

বাঙালির দুর্গাপুজো আসলে অসুর বধের উৎসব। অশুভ শক্তির বিনাশের মধ্যে দিয়ে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠাই হলো দুর্গাপুজোর মূল লক্ষ্য। ২০২৪ এ বাঙালি সেই অসুর বধের ব্রত নিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছে। তিলোত্তমা জীবন দিয়ে শাক্ত উপাসক বাঙালিকে জাগিয়ে দিয়ে গেছে। সন্দীপ ঘোষের মত অসুরদের বিনাশ হোক, অসুররা সমূলে বিনাশ হোক কেবল এটুকুই প্রার্থনা।

Feature graphic is representational and designed by NNDC.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *