কী হচ্ছে এ’সব বাংলায়? এতদিন মূলত দুর্নীতি, তোলাবাজি আর পাচারের মতো দুষ্কর্মেই সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের রাজ্য। এখন অনাচার ঢাকতে খুন-ধর্ষণও! আরজি কর মেডিকেল কলেজের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের ডাক্তারি ছাত্রী খুন নিজের কলেজ ও কর্মস্থলেই। খুনের আগে মেয়েটিকে দলবেঁধে ধর্ষণ! হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ডিউটি সেরে ওই ইন্টার্নি পাশের সেমিনার হলে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলেন। সেখানেই তাঁকে ধর্ষণ ও খুন করা হয়। যাঁরা হতভাগীর লাশ দেখেছেন শিউরে উঠেছেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, নির্যাতিতার গোটা শরীর ক্ষতবিক্ষত। দেহে ১১৩টা কামড়ের দাগ। মরার আগে দু চোখ ঠেলে রক্ত বেরিয়ে এসেছে।
এখন পর্যন্ত ঘটনায় মাত্র একজন গ্রেফতার। ধৃত সঞ্জয়কুমার রায় পেশায় সিভিক ভলান্টিয়ার। অথচ কমপক্ষে ১০-১২ জন ঝাঁপিয়ে না পড়লে একজন ৩১ বছরের মহিলার দেহ এ’ভাবে ছিন্নভিন্ন হতে পারে না। ময়নাতদন্তে খুন ও গণধর্ষণের প্রমাণ স্পষ্ট বলেই সূত্র মারফত জানা যাচ্ছে। এই নির্মম খুন ও ধর্ষণকে প্রথমে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছিল আরজি কর কর্তৃপক্ষ। তদন্তের দায়িত্বভার কলকাতা পুলিশের হাতে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের মানুষের তো কবেই প্রশাসনের উপর থেকে আস্থা উঠে গেছে। জনগণ চেয়েছিলেন সিবিআই তদন্ত। মামলা হাইকোর্টে গেলে প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্য সঙ্গে সঙ্গে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে নিজের কর্মস্থলেই কেন খুন ও ধর্ষিত মহিলা চিকিৎসক? কারণ খুঁজে বের করে জড়িত প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করা সিবিআইয়ের দায়িত্ব। আমরা চাইব, বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে সবাইকে ফাঁসিতে লটকে দেওয়া হোক। ঘটনার পরপরই পদত্যাগ করেন আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। এমনকি তিনি সরকারি চাকরি থেকেও অবসর চেয়েছিলেন বলে খবর। সকালে পদত্যাগ আর বিকেলেই তাঁকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ বানিয়ে দেয় স্বাস্থ্য দফতর। বিষয়টি নজরে আসতেই সেই নিয়োগ খারিজ করে দিয়ে ড. সন্দীপ ঘোষকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।
মেডিকেল কলেজ পরিসরে চিকিৎসককে গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনা আগে কখনও এই রাজ্যে ঘটে নি। এমনকি দেশেও নয়। গোটা দেশের কাছে বাংলার মাথা হেঁট হয়ে গেছে। নিউইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে দোষীদের বিচার চেয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। মানে বিশ্বের কাছেও আমাদের আর মুখ দেখানোর জো রইল না। ঠিক কোন কারণে কর্তব্যরত অবস্থায় নিজের কর্মস্থলেই মহিলা চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষিত হতে হল, তা তদন্তকারীরা খুঁজে বের করবেন বলে আমাদের সবার প্রত্যাশা। বাতাসে তো অনেক কথাই ভাসছে। সেইসব কথা খানিকটা সত্য হলেও ভয়ঙ্কর। আরজি কর রাজ্যের সেরা মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির একটি। সেখানে পরীক্ষায় টাকার বিনিময়ে নম্বর বন্টন হয় বলে অভিযোগ। এমনকি যৌন সম্পর্কের বিনিময়েও! একটা চক্র এইসব কাজের সঙ্গে যুক্ত। চক্রের মাথারা প্রভাবশালী। ড. শান্তনু সেন তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ। আরজি করের দুর্নীতি নিয়ে মুখ খুলে নেত্রীর রোষের মুখে পড়েছেন তিনিও। দলের মুখপাত্রের পদ হারিয়েছেন শান্তনু।
বাংলার মানুষ জানতে চায়, কারা কী কারণে মেয়েটিকে চরম দন্ড দিল? তিনি কি সব জেনে ফেলেছিলেন? নাকি তিনি কুপ্রস্তাবে রাজি হন নি? তাঁকেও কি দুর্নীতির চক্রের মধ্যে টেনে আনার চেষ্টা করেছিল কেউ কেউ? রাজি হন নি বলে তাঁকে পৃথিবীকে থেকেই সরিয়ে দেওয়া হল? একজন সিভিক ভলান্টিয়ারকে বলির পাঁঠা করে অন্যরা বাঁচতে মরীয়া? যারা এখনও আড়ালে আছে, তারা কারা? তাদের কেউ কেউ কি খুব প্রভাবশালী? তারা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়বে তো? ইতিমধ্যেই প্রমাণ লোপাট হয়ে যায় নি তো? এমন অজস্র প্রশ্ন মানুষের মনে।
এই রাজ্যে অনেক স্ক্যামেরই শেষ পর্যন্ত কিনারা হয় নি। অনেক তদন্ত দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে। জনগণের তাই আশঙ্কা, এই ভয়ঙ্কর ঘটনার সঙ্গে জড়িতরাও হয়তো শেষ পর্যন্ত পার পেয়ে যাবে। জনগণের আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করার দায়িত্ব আদালতের নির্দেশে ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআইয়ের।
Feature image is representational.