১৩ বছরে চল্লিশ থেকে পতন হতে হতে পাঁচে! বাংলায় স্থায়ীভাবে প্রান্তিক হ‌ওয়ার পথে বামেরা?

১৩ বছরে চল্লিশ থেকে পতন হতে হতে পাঁচে! বাংলায় স্থায়ীভাবে প্রান্তিক হ‌ওয়ার পথে বামেরা?


বাংলায় বামেদের পতন ও বিজেপির উত্থান যে যুগপৎ ঘটনা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বামেদের এই পতন কি স্থায়ী ? বিশ্লেষণ করলেন উত্তম দেব –

পশ্চিমবঙ্গে বামেরা কি আর কখনও ঘুরে দাঁড়াবে? এগারোতে ক্ষমতা যাওয়ার পর থেকে প্রত্যেক ভোটের আগে বাংলার বামপন্থীদের প্রিয় স্লোগান- ‘ফেরাতে হাল, ফিরুক লাল’। অর্থাৎ তৃণমূলের রাজত্বে রাজ্যের হাল খারাপ এবং তা ফেরাতে বামেদের ক্ষমতায় ফেরা জরুরি। কিন্তু মানুষ ভরসা করে লালের হাতে হাল তুলে দেওয়া দূরে থাকুক, তাদের জামানতটুকু পর্যন্ত কেড়ে নিচ্ছে। ভোটের রাজনীতিতে জামানত যাওয়া ইজ্জত যাওয়ার তুল্য। এবারের লোকসভা নির্বাচনে ২৩টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২১টিতেই জামানত বাঁচাতে পারেন নি সিপিএমের প্রার্থীরা!

সিপিএমের ভোট মেশিনারির মাথা অনিল বিশ্বাস ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রয়াত হন। আলিমুদ্দিনে বসে অনিল বিশ্বাস কখনও ভাবতে পেরেছিলেন সিপিএমকে মানুষ এইভাবে প্রত্যাখ্যান করবে? উনিশ থেকে চব্বিশ- পাঁচ বছরে তিনটি নির্বাচন; তিনটিতেই বামেরা শূন্য। ভোটের হার ভদ্রস্থ হলে আসন শূন্য পাওয়ার পরেও আশা থাকে। কিন্তু রাজ্যে বামেদের ভোটের শতাংশ যেখানে এসে ঠেকেছে, তাতে যে কোনও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বাংলার রাজনীতিতে বামেরা কি স্থায়ীভাবেই প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হতে চলল?

ধীরে ধীরে বামের ভোট রামে খেয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু রামের ঘর থেকে ভোট আবার বামের ঘরে ফিরবে- এই আত্মবিশ্বাস যে প্রপঞ্চের অতিরিক্ত কিছু নয়, চব্বিশের ফলে এই দাবি আরও জোরালো হয়েছে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৩৪ বছরের রাজ্যপাট হারানোর পরেও বামেদের ভোট ছিল ৪০.৭৭ শতাংশ। সিপিএম একাই পেয়েছিল ৩০.০৮ শতাংশ ভোট। ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় সিপিএমের ভোট কমেছিল ৭ শতাংশ। সে’বার তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট পেয়েছিল ৪৮ শতাংশ ভোট। তৃণমূলের ছিল ৩৮.৯৩ শতাংশ। কংগ্রেস ৯.০৯ শতাংশ। তখন‌‌ও বাংলায় বিজেপি প্রান্তিক শক্তি; পেয়েছিল মাত্র ৪ শতাংশ ভোট।

তিন বছর পরে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট এক লাফে ১৩ শতাংশ বেড়ে ১৭ শতাংশে পোঁছাল। দার্জিলিং অক্ষত, পদ্ম শিবিরের উপরি পাওনা আসানসোল। ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়ে সিপিএম ২৩-এ। সে’বার বামেরা পেয়েছিল ২৯.৭৭ শতাংশ ভোট ও দুটি আসন। ১১ শতাংশ ভোট খুইয়েছিল বামেরা। ৩৯.৮ শতাংশ ভোট নিয়েই তৃণমূল পেয়েছিল ৩৪টা আসন। আলাদা লড়ে কংগ্রেস পেয়েছিল ৯.৭ শতাংশ ভোট আর চারটা সিট।

২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন থেকেই বাংলায় বিজেপির ভোটবৃদ্ধি ও বামেদের ভোটক্ষয়ের চিত্রটা খুব স্পষ্ট। তবে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে কিন্তু রামের ঘর থেকে খানিকটা ভোট ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল বাম শিবির। সে’বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে বাম ও কংগ্রেস জোট করে লড়েছিল। যদিও তাতে মমতার কোন‌ও ক্ষতি হয় নি। ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ২১১টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফেরে তৃণমূল। ২৬ শতাংশ (সিপিএম- ১৯.৭৫ শতাংশ) ভোট পেয়ে বামেরা পেয়েছিল ৩২টি আসন। বামেদের সঙ্গে জোট করার সুফল পেয়েছিল প্রদেশ কংগ্রেস। ১২.২৫ শতাংশ ভোট পেলেও কংগ্রেস জয়ী হয়েছিল ৪৪টি আসনে। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় ২.৫৫ শতাংশ ভোট বাড়ে কংগ্রেসের। এই বৃদ্ধি যে বামেদের সৌজন্যে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ৩৮.২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে মোট ৭৬টি বিধানসভায় বিজয়ী হয়েছিল জোট।

২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে ১০.১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। ১৪-র লোকসভার তুলনায় বিজেপির ভোট ৬.৮৬ শতাংশ কমলেও পেয়েছিল ৩টি আসন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সৃষ্টি হ‌ওয়ার পর থেকে রাজ্য বিধানসভায় সে’বার‌ই প্রথম একসঙ্গে তিনজন প্রতিনিধি পাঠানোর রেকর্ড গড়েছিল জনসংঘ-বিজেপি। ষোলোর ভোটে ৯২টি আসনে বিরোধীদের ভোট বিজেয়ী তৃণমূল প্রার্থীদের থেকে বেশি ছিল। বিরোধী ভোট ভাগ হ‌ওয়ার লাভ সর্বত্র‌ই তোলে শাসকদল। এর চেয়েও যেটা গুরুত্বপূর্ণ, ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচন থেকেই নিজের ভোটব্যাঙ্ক মজবুত ও সুরক্ষিত করে ফেলেন মমতা। যার পেছনে সবথেকে বড় অবদান সংখ্যালঘুদের। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকার জন্য ৪৫ শতাংশ ভোট যথেষ্ট।

উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় যুগপৎ বামেদের বিপর্যয় ও বিজেপির উত্থান সত্যিই অভূতপূর্ব। সে’বার পৃথকভাবে লড়াই করে বাম শিবিরের প্রাপ্তি মাত্র ৬.৩৩ শতাংশ ভোট আর কংগ্রেসের ৫.৬৭ শতাংশ। বিয়াল্লিশে বাম শূন্য, কংগ্রেস দুই। ২০১১-তে মসনদ হারিয়েও বামফ্রন্ট ভোট পেয়েছিল ৪০.৭৭ শতাংশ। যে বাংলাকে বলা হত বামপন্থী শক্তির দুর্জয় ঘাঁটি; সেখানে ক্ষমতা হারানোর মাত্র আট বছরের মাথায় বামপন্থীদের ভোট কমল ৩৪.৪৪ শতাংশ! এতবড় ‘পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্লাইড’ সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে বিরল।

এগারোর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট মাত্র ৪ শতাংশ, আসন সংখ্যা শূন্য। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে ৪০.৭ শতাংশ ভোট, আসন ১৮। ১২১টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল বিজেপি। মাত্র আট বছরের ব্যবধানে বিজেপির ভোটবৃদ্ধি ৩৬ শতাংশ! সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এটাও একটা বিরলতম ঘটনা। বাংলায় বামেদের পতন ও বিজেপির উত্থান যে যুগপৎ ঘটনা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাঙালির বামপন্থায় প্রেম-অনুরাগ যে নেহাতই প্রপঞ্চ, উনিশে তা প্রমাণিত। যদিও আলিমুদ্দিনের কমিউনিস্টরা বললেন, মানুষের মতিভ্রম সাময়িক; বাঙালির মতি অচিরেই বামপন্থায় ফিরিবে।

আশায় বাঁচে চাষা। একুশের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে তো জোট করলোই সিপিএম; এমনকি মুসলমানদের মন পাওয়া যাবে, এই আশায় ফুরফুরা শরীফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গেও হাত মেলাল। ফল বেরোনোর পর দেখা গেল, হিন্দুদের বাম বিমুখতা আগের চেয়েও প্রকট, মুসলমানরাও সেলিম-সুজন-সূর্যকান্তদের ঘরে তুলল না। বামেদের ভোট আরও কমে মাত্র ৪.৭৩ শতাংশ। কংগ্রেসের ২.৯৩। বাম-কংগ্রেস, দু’জনেই শূন্য। তবে হ্যাঁ, দোসর আইএস‌এফ ভাঙরে জিতে খাতা খুলেছে। বিজেপি ৩৮.১৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ৭৭টি আসনে জয়লাভ করেছে। ৪৮.০২ শতাংশ ভোট পেয়ে ২১১টি আসনে জিতেছে তৃণমূল।

২০২৪-এ খেলা ঘোরানোর পণ করে মাঠে নামল আলিমুদ্দিন। এক ঝাঁক তরুণ মুখকে সামনে এগিয়ে দিল সিপিএম। হাইকমান্ডের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে একপ্রকার জোর করেই বাংলায় বামেদের সঙ্গে দলের জোট করলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। মিটিং-মিছিলে ভাল ভিড় দেখে অত্যুৎসাহী কমরেডরা ঘোষণা করে দিলেন, ঝোলা তো এবার ফাঁকা থাকবেই না এমনকি হাফ ডজন পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। ৪ জুন সূর্যদেব মাঝ আকাশে যাওয়ার আগেই স্পষ্ট, বামেরা শুধু শূন্য‌ই না, লাইন ধরে জামানত জব্দ। সেলিম-সুজন ছাড়া সিপিএমের কার‌ও জামানত বাঁচে নি। দলের তরুণ মুখরা দাগ কাটতে ব্যর্থ। এত নেচেকুঁদে সিপিএমের ভোট ৫.৬৭ শতাংশ। বামফ্রন্টের বাকি শরিকদেরটা উল্লেখ না করাই ভাল। কংগ্রেস ৪.৬৮ শতাংশ।

একদা বাংলায় যে বামেরা ৫০ শতাংশ ভোটও দখলে নিয়েছিল, উনিশ থেকে চব্বিশ- এই পাঁচ বছরে ৪ থেকে ৬ এর ঘরে ওঠানামা করছে তারা। আলিমুদ্দিনের কর্তাদের ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপের তলায় ভোটের রেজাল্টকে ফেলে দেখতে হচ্ছে কোন কোন বুথে ক ইঞ্চি ভোট বাড়ল দলের। অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে তৃণমূলের ভোট ৪৫.৭৬ শতাংশ। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় ২.২৬ শতাংশ ভোট কমেছে শাসকদলের। বিজেপির ভোট ৩৮.৭৩ শতাংশ। একুশের চেয়ে সামান্য হলেও ভোট বেড়েছে বিজেপির।

উনিশ থেকে চব্বিশ- বিজেপির ভোট ৩৮ থেকে ৪০-এর মধ্যে ওঠানামা করছে। বিরোধী দলে‌ থাকাকালীন কখনও ৩০ শতাংশের বেশি ভোট তুলতে পারে নি তৃণমূল। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে ৩৯.৮ ভোট পেয়েই ৩৪টা আসন দখল করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। পরিষদীয় রাজনীতিতে ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রধান বিরোধী শক্তি হ‌ওয়ার গুরুত্ব কতটা, এটা উপলব্ধি করতে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রয়োজন। রাজ্য বিজেপিতে এটা উপলব্ধি করার মতো নেতা হাতেগোনা।

Feature image is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *