বিশেষ প্রতিবেদন: সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতনের ঘটনা সাজানো- একটি চ্যানেলে সম্প্রচারিত ‘স্টিং’ ভিডিওকে হাতিয়ার করে তৃণমূল নেতৃত্ব এই দাবিতে বাজার গরম করলেও বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব যে সন্দেশখালি ইস্যুতে মোটেই সুর নরম করবে না; বাংলায় ভোট প্রচারে এসে তা বুঝিয়ে দিলেন অমিত শাহ। শুক্রবার রানাঘাট ও বীরভূমের রামপুরহাটে দলের দুই প্রার্থীর সমর্থনে সভা করেন শাহ। সন্ধ্যায় আসানসোলের বিজেপি প্রার্থী সুরিন্দর সিং আহলুওয়ালিয়ার হয়ে জমজমাট রোড শোতেও অংশ নেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনটি প্রচার থেকেই রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ শানান অমিত শাহ। সন্দেশখালি নিয়েও নীরব ছিলেন না তিনি। শাহ সাফ সাফ জানান, “সন্দেশখালির অপরাধীদের উল্টে করে ঝুলিয়ে সোজা করে দেব।”
সন্দেশখালিতে শাহজাহান শেখের বাহিনী আদৌ কোনও নারী নির্যাতন করে নি। পুরো ঘটনাটাই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সাজানো, স্টিং ভিডিওর ফুটেজ দেখিয়ে এমনই অভিযোগ অভিষেক ও মমতার। স্টিং ভিডিওতে যাদের কথা বলতে দেখা গেছে, তাদের একজন সন্দেশখালি-২ ব্লকের বিজেপির মন্ডল সভাপতি গঙ্গাধর কয়াল। কয়েকজন মহিলাকেও ভিডিওতে মুখ খুলতে দেখা গেছে। চাপের মুখে তারা নির্যাতনের মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে সন্দেশখালির ওই মহিলাদের বলতে শোনা যাচ্ছে। হাইকোর্টের নির্দেশে সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতন মামলার সিবিআই তদন্ত চলছে। অথচ ফরেন্সিক টেস্টে যাচাই না হওয়া কয়েকটি স্টিং ভিডিওকে হাতিয়ার করে সন্দেশখালির প্রতিবাদী নির্যাতিতা মহিলাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করতে উঠেপড়ে লেগেছে রাজ্য পুলিশ। স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার অভিযোগের ভিত্তিতে ইতিমধ্যেই বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র সহ সন্দেশখালির কয়েকজন মহিলার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে স্থানীয় থানা।
সন্দেশখালি নিয়ে মারমুখী মেজাজেই শাহ থেকে শুভেন্দু
সন্দেশখালির নির্যাতিত মহিলাদের ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করতে আইপ্যাকের প্রতীক জৈনের সহায়তায় তৃণমূল এইসব ভিডিও বাজারে ছেড়েছে বলে শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ। তাঁর মুখে কথা বসিয়ে ভুয়ো ভিডিও বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ সন্দেশখালির বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়ালেরও। এই ঘটনায় সিবিআইয়ের কাছে অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি হাইকোর্টেরও দ্বারস্থ হয়েছেন গঙ্গাধর। সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতনের অভিযোগ সাজানো হয়েছে, এই অভিযোগে পুলিশ গঙ্গাধর কয়ালের বিরুদ্ধেও এফআইআর দায়ের করেছে। এই মামলায় পুলিশ শুভেন্দুর নামেও এফআইআর করার অনুমতি চেয়ে হাইকোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের ধারণা হয়েছিল, স্টিং ভিডিও কান্ডে চাপে পড়ে গিয়ে সন্দেশখালির নারী নির্যাতন নিয়ে আর তেমন শোরগোল তুলবে না বিজেপি। কিন্তু দেখা গেল, অমিত শাহ থেকে শুভেন্দু অধিকারী- কেউই সন্দেশখালি ইস্যুতে গলা নামিয়ে কথা বলতে রাজি নন। বরং তাঁদের মারমুখী মেজাজ আগের থেকেও চড়া। শুক্রবার রাজ্যে প্রচারে এসে অমিত শাহ বলেন, “মমতা এক জন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর উপস্থিতিতে মহিলাদের শোষণ করা হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। করেছেন ওঁর দলের নেতারা। ওঁর লজ্জা করা উচিত। সিবিআই তদন্ত করছে। বাংলার মা, বোনদের চিন্তার দরকার নেই। আমরা সন্দেশখালির অপরাধীদের উল্টো ঝুলিয়ে সিধে করে দেব।’’
স্টিং ভিডিও কান্ডে শাহের চালে চাপে কি মমতাই?
সন্দেশখালিতে হিন্দু জনগোষ্ঠীর অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মহিলারা শেখ শাহজাহানের লোকেদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন বলে অভিযোগ। একটি-দুটি নয়, নারী নির্যাতনের ৩৭৯টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অভিযুক্তরা জেলে। কয়েকজনকে জনরোষের মুখে রাজ্য পুলিশই গ্রেফতার করেছে। দিন কয়েক আগেই বাংলায় প্রচারে এসে মমতাকে পাল্টা চাপে ফেলতে শাহ বলেছিলেন, “মমতাদি, আপনি আগে বলেন সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহান দোষী না নির্দোষ!” শুভেন্দু সহ রাজ্য বিজেপির নেতারা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করে দিয়েছেন, “বসিরহাটের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতেই লোকসভা ভোটের মুখে ভুয়ো ভিডিও ছড়িয়ে সন্দেশখালির অনগ্রসর সম্প্রদায়ের নির্যাতিত মহিলাদের অপমানিত করছে তৃণমূল।”
রেখা পাত্র সহ যে নির্যাতিত মহিলারা শেখ শাহজাহান বাহিনীর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ভিডিও কান্ডের জেরে তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ কড়া কোনও পদক্ষেপ করলে বিজেপি যে ছেড়ে কথা বলবে না, সেই ইঙ্গিত মিলেছে। এই প্রেক্ষাপটে মমতা ও অভিষেক চাইলেও শেখ শাহজাহানকে নির্দোষ সার্টিফিকেট দিতে পারবেন না বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতনের ঘটনা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি মামলা। নিজের এলাকায় শেখ শাহজাহানের যে মহাপুরুষ হিসেবে কোনও পরিচিতি নেই, তা মমতা ভাল করেই জানেন। সন্দেশখালির নারী নির্যাতনকে মিথ্যে প্রমাণ করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করলে দলের জন্য ভোটে উল্টো ফল হতে পারে বলে ইতিমধ্যেই কেউ কেউ গুঞ্জন তুলে দিয়েছেন তৃণমূলের ভেতরে।
Feature photo- collected.