গ্রামের সরল গল্প কিন্তু বুনট চমৎকার। তাই তো ‘পঞ্চায়েত’-এ মজে দেশশুদ্ধ মানুষ। ‘সিজন-থ্রি’ দেখা শেষ, এখন ‘ফোর’-এর জন্য ছটফটানি। লিখলেন ঋতুপর্ণা কোলে-
সেটা ছিল করোনার সময়। লকডাউন শুরু হয়ে গেছে। গৃহবন্দী মানুষ মুঠোফোন, ল্যাপটপ আর টিভির ভেতর দিয়ে দেখছে বাইরের জগতটাকে। সারা বিশ্বে তখন নির্মল বাতাসের আকাল। এরই মাঝে ২০২০-এর ৩রা এপ্রিল তারিখে আমাজন প্রাইমে বিশুদ্ধতা, স্বচ্ছতা, সারল্য নিয়ে হাজির হল ফুলেরা গ্রাম। বাঙালি মাত্রই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোষ্টমাস্টার’ গল্পের সঙ্গে পরিচিত। শহর থেকে গ্রামে চাকরি করতে যাওয়া শহরের ছেলে ‘পোষ্টমাস্টার’-কে রবীন্দ্রনাথ “ডাঙায় তোলা মাছ”-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। উলাপুরে ‘পোস্টমাস্টার’ টিকতে পারেন নি। ‘পঞ্চায়েত’ সিরিজটার শুরুটা এরকমই অনেকটা।
শহরের ছেলে অভিষেক এটা ওটা চাকরির চেষ্টা করতে করতে পঞ্চায়েত সচিবের কাজ পেয়ে যায়। সারাজীবন শহরে বেড়ে ওঠা ছেলেটা জীবনের কয়েকটা দিনের ‘ব্রেক’ ভেবে কাজটি নেয় এবং ফুলেরা গ্রামে পৌঁছে যায়। উলাপুর ফুলেরা হয়ে উঠতে পারেনি। তাই সচিবজি ও দর্শক আদ্যোপান্তভাবে বাঁধা পড়ে যায় ফুলেরা সঙ্গে, ফুলেরার মানুষগুলোর সঙ্গে। করোনার কারণে গৃহবন্দী আমরা ঘুরে বেড়াই, প্রাণ খুলে শ্বাস নিই ফুলেরার আনাচে কানাচে। এরপর ২০২২ সালে আসে সিজন টু। দু’বছরের অপেক্ষার অবসান শেষ হয়। আসা মাত্র জয় করে নেয় দর্শক হৃদয়। মানুষের ভালোবাসা ছাপিয়ে যায় প্রথম সিজনকেও। সচিবজি ধীরে ধীরে গ্রামেরই একজন হয়ে উঠেছে। গ্রামের সমস্যা ও তার সমাধান নির্ভেজাল হাস্যরসের সঙ্গে মিলে যায়।
প্রায় গোটা সিরিজটাই হয়ে ওঠে মিম মেটেরিয়াল। গ্রামের মানুষের সারল্য, বিধায়কের নোংরা রাজনীতি সবকিছু মানুষকে হাসাতে হাসাতে দুম করে কাঁদিয়ে দেয়। অজস্র জিজ্ঞাসাকে সঙ্গে নিয়ে সেই কান্নার রেসটুকুকেই বয়ে চলতে হয় আরও দুটো বছর। প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতেই আসে তৃতীয় সিজনের ট্রেলার। সন্তান হারানো উপপ্রধানের হাসিমুখটুকু দেখে সকল দর্শক যেন শান্তির শ্বাস ফেলে। পঞ্চায়েত সিরিজের সাফল্য এখানেই। প্রতিটা চরিত্র দর্শকের আপনজন হয়ে উঠতে পেরেছে।
২৮শে মে,২০২৪- দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমাজন প্রাইমে এল পঞ্চায়েত ওয়েব সিরিজের তৃতীয় সিজন। সক্ষম কি হলো মানুষের প্রত্যাশার পারদকে স্পর্শ করতে? ফুলেরার রাস্তা এবারেও হল না, রিঙ্কি অভিষেকের প্রেম এবারেও দানা বাঁধল না তবু টানা ছয় সাত ঘন্টা স্রোতের মধ্যে গা এলিয়ে বসে থাকার মতো কেটে গেলো স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। আর কেউ নয় এই সিজনের সব আলো একাই কেড়ে নেবেন প্রহ্লাদজী তথা ফাইজল মালিক। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার একটা বাড়ি পাবার লোভে বুড়ি দাদি যখন মিথ্যে অভিনয়ের আশ্রয় নেয় সে’সময় প্রহ্লাদচাচা আর দাদির কথপোকথন একটু ভালোর আশায় আপনজনকে ছেড়ে থাকা প্রতিটা মানুষের হৃদয়ে একবার হলেও মোচড় দেবে।
এই সিজনে সচিবজি বিধায়কের চক্রান্তকে ধুলোয় মিশিয়ে ফুলেরায় ফিরে আসবে ঠিকই কিন্তু তা যে বেশিদিনের জন্য নয় তা শুরুতেই সকলের জানা হয়ে যাবে। সামনে পঞ্চায়েত ভোট। গোদির লড়াই ফুলেরাবাসীকে মহাযুদ্ধের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। প্রতিটা চরিত্র এক একটা বইয়ের পাতা খোলার মতো নিজেকে মেলে ধরবে নানাভাবে। বিধায়ক, বম বাহাদূর, বনরাকস এমনকি মঞ্জু দেবী। লোকদেখানো প্রধানের পদে থাকতে থাকতে রাজনৈতিক বিচারবোধে বেশ সজাগ হয়ে উঠেছেন মঞ্জু দেবী। ভালো মানুষ প্রধানজির পক্ষপাত মূলক আচরণ, ঘোড়াকে জড়িয়ে ধরে বিধায়কের কান্না প্রমাণ করে দিল পঞ্চায়েত এখানেই অনন্য। আপাত খারাপ ভূষণ কি সত্যিই খারাপ? প্রধানজির বিরোধিতায় আপন স্বার্থর থেকেও তার কাছে বড়ো হয়ে ওঠে গ্রামের স্বার্থ। খারাপ রাস্তা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়ির সঠিক বন্টন তো সেও চায়। ভাল-খারাপ মিশিয়ে মানুষ আর পঞ্চায়েত আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষের চরিত্রের চিত্রন। কোনো আদর্শবাদের ধারক বাহক প্রচারকের কাহিনি নয়।
গত সিজনেই আলাদা করে নজর কেড়েছিলো ‘বনরাকস’ তথা ভূষণের চরিত্রে থাকা দুর্গেশ কুমার। ‘পঞ্চায়েত’ সিরিজের নির্মাতারা চরিত্র অভিনয়ে জন্য এক একটা মণি মাণিক্য সংগ্রহ করে তার মালা গেঁথেছেন। অনেকেরই এই সিরিজ জীবনের প্রথম কাজ। কিন্তু অভিনয় দক্ষতায় সেই নতুনের পরিচয় ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। নীনা গুপ্তা, রঘুবীর যাদবের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে সমান তালে তাল মিলিয়ে অভিনয় করে চলেছেন। উল্লেখ্য বিনোদের ভূমিকায় অশোক পাঠক এবং বিকাশের ভূমিকায় চন্দন রায়। বাকি সিজনের মতো এবারেও গান “কাণের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো”। কথক ঠাকুরের মতো গান এই সিরিজে অনেক কিছু বলে যায় আর যেন চিত্রকল্পের প্রতিচ্ছবি স্ক্রীনে দেখি। তৃতীয় সিজনও তার ব্যতিক্রম নয়।
পঞ্চায়েত সিরিজে সারল্যের পাশাপাশি আর একটা বড়ো মূলধন হলো প্রেম। উত্তাল উদ্দাম নয়, ন্যাকা গ্যাদ গ্যাদে নয়। সুরক্ষিত ও সুরভিত একটা প্রেম। খুব সন্তর্পনে ডিরেক্টর খুলছেন সচিবজি আর রিঙ্কির একে অপরের প্রতি ভালোবাসার খাতা। বাস্তবকে বোঝেন নির্মাণ কর্তারা। একটু অসাবধনতা ঘটিয়ে দিতে পারে অনর্থ। এখনও গ্রামের মানুষের চোখে নারী পুরুষের প্রেম অতি অশ্লীল জিনিস। সে সব কিছুকে মাথায় রেখে যেভাবে একটা শ্লথ প্রেমকাহিনি সবার অলক্ষ্যে এগোচ্ছে তা কখন যে হাজার হাজার প্রেমিক প্রেমিকার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে ফেলছে তা হয়তো নির্মাতারা জানেন না।
অনেক সমালোচক সিরিজটার সমালোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ফুলেরার কোনো উন্নতি ধরা পড়ল না। যা ছিলো তাই। যেন বদ্ধ জলাশয় গ্রামটা আটকে। আসলে গ্রাম নয়, সময়টা আটকে। দ্বিতীয় সিজনের দু’বছর পর তৃতীয় সিজন দেখলেও কাহিনির শুরু ঠিক সেখান থেকেই যেখানে দ্বিতীয় সিজনের সমাপ্তি। গত সিজনের হাস্যরস এই সিজনে নেই। তার পরিবর্তে আছে একটা গাম্ভীর্য। পঞ্চায়েত TVF-এর এমন এক সিরিজ যা আকাঙ্খার নিবৃত্তি ঘটায় না। অনন্তকাল স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে তার থেকেও বড়ো কথা যে হচ্ছে। এই সিজন যেন মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের প্রস্তুতি পর্ব। গল্প বলার আগের ভূমিকা মাত্র। এবারে মহাসংগ্রামের প্রতিটা যোদ্ধার সঙ্গে পরিচয় ঘটলো মাত্র, যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া হলো কেবল এবং সমাপ্তিতে হলো আরও একরাশ প্রতীক্ষার শুভ সূচনা।