মথুরাপুর: মঙ্গলের পর বুধেও বাংলায় মোদী। মঙ্গলবার বারাসতের অশোকনগর ও যাদবপুরের বারুইপুরে জোড়া সভা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। বারাসতে রোড শোও করেন তিনি। সন্ধ্যায় উত্তর কলকাতার বিজেপি প্রার্থী তাপস রায়ের সমর্থনে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি পর্যন্ত মোদীর বর্নাঢ্য রোড শো ঘিরে মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল চোখে পড়ার মতোই। ১ জুন রাজ্যে যে নয় আসনে ভোট, তা রাজনৈতিক মহলে তৃণমূলের দুর্গ হিসেবেই পরিচিত। যদিও মোদী তা মানছেন না। শেষ দফার আগে রাজ্যে এসে প্রধানমন্ত্রীর দাবি, “গত দু’মাস ধরে পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় ঘুরেছি। মানুষের মনোভাব দেখে বুঝেছি, এবার তৃণমূল ও ‘ইন্ডি’ জোটের বড় বড় কেল্লা বিধ্বস্ত হতে চলেছে। ৪ জুন ভোটের ফল প্রকাশ হলে দেখা যাবে, বাংলায় বিরাট সংখ্যায় পদ্ম ফুটেছে।”
মোদীর কথায় স্বাভাবিক ভাবেই গা জ্বলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বেহালা পশ্চিমে চৌরাস্তার সভা থেকে মমতা জবাব দেন- “আর মাত্র সাত-দিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন মোদী। এরপর এক্স প্রাইম মিনিস্টার হয়ে যাবেন।” কে ঠিক, কে ভুল- প্রমাণ হবে ৪ জুন বিকেলের মধ্যেই। তবে বাংলা থেকে বেশি আসন জেতার লক্ষ্যে বিজেপি যে এবার সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিমধ্যেই বাংলা প্রায় চষে ফেলেছেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী। শাহ সহ বাকি নেতারা তো আছেনই। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ভোরে ঘরে থেকে বেরিয়ে ফিরছেন মধ্যরাতে। মমতার মতো হেলিকপ্টার কিম্বা প্রাইভেট জেটে নয় চার চাকার গাড়ি নিয়েই এক জেলা থেকে আরেক জেলায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন শুভেন্দু।
পর পর দু’দিন বাংলায় কর্মসূচি দেখে মঙ্গলবার রাতে কলকাতাতেই থেকে যান প্রধানমন্ত্রী। বুধবার সকালে মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অশোক পুরকায়েতের সমর্থনে কাকদ্বীপ স্টেডিয়ামে আয়োজিত সভায় বক্তব্য রাখেন মোদী। সভায় জয়নগর ও ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের দুই বিজেপি প্রার্থী অশোক কান্ডারী ও অভিজিৎ দাসও উপস্থিত ছিলেন। মথুরাপুর ও জয়নগর- দুটিই তফসিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসন। তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত জাতির মানুষ বেশি থাকায় মথুরাপুরে জেতার সম্ভাবনা দেখছেন বিজেপি নেতৃত্ব। হাইকোর্টের রায়ে ওবিসি সার্টিফিকেট নিয়ে এমনিতেই বেকায়দায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। অনগ্রসর সম্প্রদায়ের হিন্দুদের বঞ্চিত করে বেআইনিভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের ৭৭টি জাতিকে পশ্চিমবঙ্গে ওবিসি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ২০১১ সালের পর থেকে রাজ্যে যত ওবিসি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল বলে রায় দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ।
মথুরাপুরের সভায় মোদী অভিযোগ করেন, “৭৭টি মুসলিম জাতিকে অসাংবিধানিকভাবে ওবিসি ঘোষণা করেছিল টিএমসি সরকার। এর ফলে বঞ্চিত হয়েছে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের অনেক জাতি। তবে হাইকোর্টের রায়ে তৃণমূলের ষড়যন্ত্র ভেস্তে গেছে। কিন্তু এখন মমতাজি বলছেন, আদালতের রায় তিনি মানবেন না।” প্রধানমন্ত্রী বলেন, “হাইকোর্টের রায় মানতে তৃণমূল সরকার বাধ্য। আসলে তুষ্টিকরণের জন্য সংবিধানের উপরেও হামলা চালিয়েছে তৃণমূল। আমাদের সংবিধান দলিত-অনগ্রসরদের সংরক্ষণ দিয়েছে। কিন্তু বাংলায় তা লুঠ হয়েছে। ওবিসিদের অধিকার কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা হাইকোর্ট তৃণমূল সরকারের এই অন্যায় ও অসাংবিধানিক কান্ড রদ করেছে। তৃণমূল তা মানতে বাধ্য।” প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষ, “ভোটের স্বার্থে তৃণমূল মুসলিমদেরও ভুল বুঝিয়েছে। তাদের ভুয়ো ওবিসি সার্টিফিকেট দিয়েছে তৃণমূল সরকার।”
সিএএ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগেরও জবাব দেন নরেন্দ্র মোদী। মোদী বলেন, “সিএএ নিয়েও মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে তৃণমূল। সিএএ নাগরিকত্ব দেওয়ার কানুন, নাগরিকত্ব কাড়ার কানুন নয়।” মোদী আরও বলেন, “সিএএ নিয়ে কেন টিএমসি মিথ্যে বলেছে? কেন বিরোধিতা করেছে? আসলে অনুপ্রবেশকারীদের বাংলায় ঢোকানোর জন্য তৃণমূলের এই বিরোধিতা।” প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, “হিন্দু শরণার্থীদের জায়গা দেবে না টিএমসি। মতুয়াদের থাকতে দিতে চায় না। অথচ বাংলায় অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে আসছে তৃণমূল। অনুপ্রবেশকারীরা বাংলায় এসে আপনাদের জমিজায়গা কেড়ে নিচ্ছে। বাংলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলির জনবিন্যাস বদলে গেছে। তবে ৪ জুনের পর তৃণমূলের সব হাওয়া বেরিয়ে যাবে।” মথুরাপুরের সভায় দাঁড়িয়ে মোদী আশ্বাস দেন, “আমাদের মতুয়া ও নমঃশূদ্র সমাজ নিজেদের অধিকার ফিরে পাবেন। সকল শরণার্থীকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।”
তৃণমূল মঠ-মিশনের সাধুসন্তদেরও ছেড়ে কথা বলে না বলে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। মোদীর আ়ক্ষেপ, “এখানে মানবতার সেবা করা সন্তরাও নিরাপদ নন। সাধুসন্তরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললে তাঁদের বেঁচে থাকাই মুশকিল করে দেয় তৃণমূল। রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম ও ইসকনের মতো প্রতিষ্ঠানের সন্তদেরও গালিগালাজ করা হয়। তাঁদের আশ্রমে হামলা পর্যন্ত চালায় তৃণমূলের গুন্ডারা।” তৃণমূল যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন বাংলার কোনও উন্নতি হবে না বলে মথুরাপুরের সভায় দাবি করেছেন মোদী। তৃণমূলকে কটাক্ষ করে মোদী বলেন, “ওদের কাছে একটাই অস্ত্র- ‘এটা হতে দেবো না, ওটা হতে দেবো না।’ বিকাশের জন্য মোদী যা করেন, তৃণমূল বলে সেটা হতে দেবো না।” মোদী মনে করেন, “বিজেপির প্রতি বাংলার ভালবাসা তৃণমূল সহ্য করতে পারছে না। সেই জন্য ওরা ক্ষেপে গিয়েছে। ক্ষেপে গিয়ে কী সব বলে! বিজেপিকে ঘৃণা করতে গিয়ে বাংলাকেই ঘৃণা করছে তৃণমূল।”
মথুরাপুরের সভা দিয়েই সাত দফার লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদীর প্রচার শেষ। মোদী বলেন, “এই নির্বাচনে বাংলায় এটাই আমার শেষ সভা। এরপর আমি ওড়িশা ও পাঞ্জাবে যাব। এ’বারের নির্বাচন আলাদা ও অদ্ভুত। মানুষ ৬০ বছরের দুর্দশা ও ১০ বছরের উন্নতি দেখেছে। ভারতে অনাহার ছিল। আমাদের থেকে ছোট দেশ কোথায় পৌঁছে গিয়েছে। আমাদের যুব সম্প্রদায়ের এত মেধা ও বুদ্ধিমত্তা! অথচ তাঁরা পিছিয়ে ছিল। কিন্তু দশ বছরে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। এখন সারা বিশ্ব ভারতের গুণগান গাইছে।”
৪ জুন ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে যে তিনি নিশ্চিত, মথুরাপুরের সভায় বুঝিয়ে গেলেন মোদী। নরেন্দ্র মোদী বলেন, “৪ জুন থেকেই বিকশিত ভারত নির্মাণ হবে। ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে চলেছে। বিকশিত ভারতের জন্য বিকশিত বাংলা প্রয়োজন। এইজন্যই বাংলা থেকে বিজেপি প্রার্থীদের জেতানো জরুরি। আপনারা আশীর্বাদ করুন। আমি আপনাদের বিকশিত ভারত গড়ার ভরসা দিচ্ছি।”
Feature image source: NNDC