আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইরান-ইজরায়েল সংঘাত চরমে ওঠায় উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক মহল। কেননা, দুই দেশ পুরোপুরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তা আর মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলিও এতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। আমেরিকা ও তার মিত্রবর্গ ইজরায়েলকে রক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এদিকে রাশিয়ার বড় বন্ধু ইরান। ইউক্রেন যুদ্ধে ড্রোন সহ নানা সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে পুতিনকে সাহায্য করে চলেছে তেহেরান। ইজরায়েল বা আমেরিকার হাতে ইরানের ভূখন্ড আক্রান্ত হলে পুতিনের পক্ষে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব হবে না। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইজরায়েলকে ঘিরে আমেরিকা-রাশিয়া মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা পর্যন্ত উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তবে আশার কথা, পুরো দস্তুর যুদ্ধের পরিণাম সম্পর্কে সব পক্ষই সচেতন বলে মনে হচ্ছে। লেবাননের শিয়াপন্থী মিলিশিয়া হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর মাধ্যমে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে একটি ‘প্রক্সি ওয়ার’ ইরান বহুদিন ধরেই চালু রেখেছে। গাজায় হামাস জঙ্গিদের অস্ত্রশস্ত্রের যোগানদারও ইরান। এর বদলা নিতে মাঝেমধ্যেই লেবানন-সিরিয়া ও ইরাকে মিসাইল হামলা চালিয়ে এইসব দেশে অবস্থানরত ইরানের উচ্চপদস্থ সামরিক কমান্ডারদের মেরে ফেলে ইজরায়েল। এর আগের আঘাতগুলি হম্বিতম্বি শেষে তেহেরান হজম করে নিলেও ১ এপ্রিলের ঘটনা মেনে নিলে দেশের নাগরিকদের সামনে ইরানের নেতাদের মান থাকে না। সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে ইরানের দূতাবাসে ইজরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দেশটির রেভোলিউশনারি গার্ড কপর্সের শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার মহম্মদ রেজা জাহেদি এবং এক কূটনীতিক সহ নয়জন নিহত হয়েছিলেন।
ইজরায়েলকে দিনক্ষণ জানিয়ে হামলা ইরানের?
১ এপ্রিলের হামলার বদলা নিতেই শনিবার রাতে ইজরায়েলের ভূখন্ড লক্ষ্য করে ২০০টি ড্রোন ছুড়েছে ইরান। তেহেরান যে এমন কিছু সামরিক পদক্ষেপ করবে, সেই আভাস ইরানের শত্রু-মিত্র সকলের কাছেই ছিল। ইজরায়েলকে জবাব দিতে ১৩ দিন অপেক্ষা করেছে তেহরান। শনিবারের হামলার ধরণ-ধারণ দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, এই ১৩ দিনে সব পক্ষই তলে তলে একটা কূটনৈতিক বোঝাপড়ায় পৌঁছতে পেরেছে। তারই ফলশ্রুতিতে শনিবার রাতে ইজরায়েলের উপর ইরান এমন একটা হামলা চালালো, যা নিয়ে আগেই একাধিক পক্ষের মধ্যে তথ্য চালাচালি হয়ে গিয়েছিল। ইরান কটার সময় ইজরায়েলে হামলা চালাবে। কোন পথ দিয়ে ড্রোনগুলি উড়ে আসবে। ইরানের পাঠানো ড্রোন ধ্বংসে কোন কোন দেশ সহযোগিতা করবে এবং কী পরিকল্পনা নেওয়া হবে, তার সবই মনে হয় আগাম ঠিক করাই ছিল।
ইরানের পাঠানো দুশোটি ড্রোনের মধ্যে মাত্র দুটি ইজরায়েলের ভূখন্ডে আঘাত করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে এবং এতে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাকি সমস্ত ড্রোন আকাশেই ধ্বংস করে দিয়েছে আমেরিকা ও ইজরায়েলের যৌথ আকাশ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি। এবং এই কাজে ইজরায়েল ও আমেরিকাকে সাহায্য করেছে জর্ডন সহ মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার আরও কয়েকটি মিত্রদেশ। ইরানের ড্রোন হামলার জবাবে এখনও পর্যন্ত ইরানে কোনও হামলা করে নি ইজরায়েল। ইজরায়েল এই ধরণের কোনও পদক্ষেপ করলে কঠিন জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। তেহরানের ভাষা শুনে মনে হচ্ছে, তাদের কাজ শনিবারই শেষ হয়ে গেছে। ইজরায়েলের তরফ থেকে যে ধরণের প্রতিক্রিয়া জানানো হচ্ছে, তাতেও অভিনয়ের ছাপ স্পষ্ট। ইজরায়েল কোনও পাল্টা হামলা করবে না, এই আশ্বাস পাওয়ার পরেই কি ইজরায়েলের ভূখন্ডে তাক করে ড্রোন উড়িয়ে ছিল ইরান? ১ এপ্রিল দামাস্কাসে ইরানের দূতাবাসে ইজরায়েলের হামলার পর থেকেই যে বাইডেন প্রশাসন কূটনৈতিক স্তরে দারুণ সক্রিয় ছিল, শনিবারের ঘটনা তা প্রমাণ করে।
সাজানো আক্রমণ চালিয়ে জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে নিল ইরান
ইজরায়েলকে নিয়ে একমাত্র সিরিয়া বাদে প্রতিবেশী আর কোনও মুসলিম রাষ্ট্রের মাথাব্যথা নেই। কিন্তু শিয়া ইরান এখনও মানচিত্র থেকে ইজরায়েল রাষ্ট্রকে মুছে দিতে চায়। মুসলিম দুনিয়ায় শিয়ারা নগণ্য এবং গোঁড়া সুন্নিরা শিয়া মাজহাবকে মুসলমান বলে পর্যন্ত মানতে চায় না। বিশ্বের মুসলমান দেশগুলির মধ্যে সামরিক শক্তিতে ইরান নিঃসন্দেহে সবথেকে শক্তিশালী কিন্তু শিয়া হওয়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব সীমিত। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবথেকে বড় বন্ধু এবং কৌশলগত অংশীদার সৌদি আরব। সুন্নি সৌদি আরবের সঙ্গে শিয়া ইরানের টানাপোড়েন দীর্ঘ দিনের। এক সময় আমেরিকার বলয়ে থাকা ইরান আয়াতোল্লা খোমেনির ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকেই ওয়াশিংটনের দুশমন। উপসাগরীয় অঞ্চলে একমাত্র ইরানই এখন আমেরিকার সবথেকে বড় মাথাব্যথার কারণ। ইরান মুসলিম দুনিয়ার অভিভাবক হতে চায় কিন্তু শিয়া ইরানের নেতৃত্ব মেনে নিতে সুন্নি নিয়ন্ত্রিত মুসলিম দুনিয়ার বিশেষ আগ্রহ নেই। তারপরেও ইজরায়েলে ইরানের ড্রোন হামলার সংবাদে সারা পৃথিবীর সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে উল্লাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইজরায়েলে ড্রোন হামলা ঘটিয়ে তেহরানের প্রাপ্তি বলতে এই টুকুই।
পরমাণু শক্তিধর ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে না তেহেরান
আয়তনে ইরান ইজরায়েলের থেকে ৭৫ গুণ বড়। জনসংখ্যাতেও ইরানের ধারেকাছে নেই ইজরায়েল। ইরানের জনসংখ্যা ৮ কোটি ৭৫ লক্ষ ৯০ হাজার ৮৭৩। ইজরায়েলের ৯০ লক্ষ ৪৩ হাজার ৩৮৭ মাত্র। এই মুহূর্তে পশ্চিম এশিয়ায় ইরানের সামরিক বাহিনী আড়ে-বহরে সর্ববৃহৎ। ইরানের সামরিক বাহিনীতে সক্রিয় সৈন্যের সংখ্যা ৫ লক্ষ ৮০ হাজার। আরও ২ লক্ষ ‘রিজার্ভ’ সৈনিক সামরিক বাহিনী ও ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ডস কর্পসের মধ্যে বাটোয়ারা করা আছে। পক্ষান্তরে ইজরায়েলের রয়েছে ১ লক্ষ ৬৯ হাজার ৫০০ জন সক্রিয় সৈন্য। আরও ৪ লক্ষ ৬৫ হাজার রয়েছে রিজার্ভে। যদিও ইজরায়েলের নাগরিকদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক এবং দেশ রক্ষায় ইজরায়েলের প্রত্যেকটি মানুষই অস্ত্র ধরতে সক্ষম।
জনসংখ্যা ও আয়তনে ইজরায়েল ইরানের ধারেকাছে না আসলেও প্রতিরক্ষা খাতে ইজরায়েলের বরাদ্দ ইরানের দ্বিগুণেরও বেশি। ‘দ্য গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স’-এর দেওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাজেট যেখানে ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সেখানে ইরানের মাত্র ৯.৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বোমারু ড্রোন ও দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বা আইসিবিএম নির্মাণে ইরান উল্লেখযোগ্য উন্নতি করলেও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে ইজরায়েলকে পাল্লা দেওয়ার জায়গায় এখনও পৌঁছায় নি। ইজরায়েলের যুদ্ধবিমানের সংখ্যা ইরানের থেকে বেশি। ইজরায়েলের হাতে আছে ৬১২টি যুদ্ধবিমান। ইরানের রয়েছে ৫৫১টি। তার চেয়েও বড় কথা, ইজরায়েলের বিমান বাহিনী দুর্ধর্ষ। ইজরায়েলের রয়েছে এফ-ফিফ্টিন, এফ-সিক্সটিন এবং এফ-থার্টিফাইভের মতো অত্যাধুনিক ফাইটার জেট। আক্রমণ ক্ষমতা এবং আধুনিকতা- দুই দিক দিয়েই ইজরায়েল বিমান বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত।
একটি দেশের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে শেষ পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্রের কোনও বিকল্প নেই। ইরানের পরমাণু বোমা বানানোর প্রকল্প সফল হয়েছে বলে এখনও পর্যন্ত কোনও তথ্য নেই। সরকারিভাবে ইরান পরমাণু অস্ত্রমুক্ত দেশ। ইরানের পরমাণু কর্মসূচির উপর আমেরিকা ও ইজরায়েলের কড়া নজরদারি। ইজরায়েল ও আমেরিকার নজর এড়িয়ে ইরানের পক্ষে গোপনে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ করা কার্যত অসম্ভব। অন্যদিকে ইজরায়েলের হাতে এই মুহূর্তে কমপক্ষে ৮০টি পরমাণু অস্ত্র মজুদ আছে বলে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে প্রকাশিত। পরমাণু অস্ত্রধর ইজরায়েলের সঙ্গে পুরোদস্তুর যুদ্ধে যাওয়ার ঝুঁকি তেহরানের মোল্লাতান্ত্রিক রেজিম নেবে বলে মনে হয় না।