নির্মাণ যত বেশি বেআইনি, তত বেশি কামাই, শুধু ভেঙে পড়লেই ববি দেন সাফাই

নির্মাণ যত বেশি বেআইনি, তত বেশি কামাই, শুধু ভেঙে পড়লেই ববি দেন সাফাই


ববিদার বরাত থেকেও দেখা যাচ্ছে ইদানিং সুখ জিনিসটা চলে গেছে। এক সময় ফিরহাদ হাকিমের হাবভাব দেখলে মনে হত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বা উজিরে আলা হলেও কলকাতার জায়গিরদার একমাত্র ফিরহাদ‌ই। মিনি পাকিস্তানের বড় নেতা হ‌ওয়ার সুবাদে দলের ভেতরে তাঁর রোয়াব‌ই আলাদা। মিনি পাকিস্তানের ভোটারদের কথা মাথায় রেখে খোদ দলনেত্রীও যে ববিকে তোয়াজ করে চলেন, তৃণমূলের ভেতরে সবাই তা জানে। শোনা কথা, একদা নেত্রীর কালীঘাটের বাড়ির চালে ঢিল মেরেও দিব্যি পার নয় দলে ও সরকারে প্রোমোশনের পর প্রোমোশন পেয়েছেন তিনি। তবে ভাইপোর সঙ্গে বনিবনা না থাকায় গত তিন বছর ধরে দলের ভেতরে সময় সময় অস্বস্তিতেও পড়তে হচ্ছে ফিরহাদ হাকিমকে।

গার্ডেনরিচে নির্মীয়মাণ যে ভবনটি চাপা পড়ে দশজনের এন্তেকাল হয়েছে, গোটা পশ্চিমবঙ্গের সবাই এতক্ষণে জেনে গেছে, তা বেআইনি। ভবনটি অক্ষত থাকলে কে জানত, তা বেআইনি? প্রোমোটারদের বেআইনি বাড়ি নির্মাণের সুযোগ করে না দিলে কাউন্সিলররা দেড় কোটি টাকা দামের গাড়ি নিয়ে ঘুরবেন কীভাবে? কলকাতা শহরের অলিতে গলিতে এখন বেআইনি নির্মাণ। কলকাতা শহরের মধ্যে আবার বেআইনি নির্মাণের সংখ্যা সবথেকে বেশি গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ ও খিদিরপুর অঞ্চলে। ফিরহাদ হাকিম কথিত এই মিনি পাকিস্তানে দেশের আইনকানুন লাগু করতে প্রশাসন ভয় পায়। এই এলাকার কাউন্সিলররা এক-একজন ডন। তাঁরা কেমন রোয়াবে চলাফেরা করেন, স্থানীয় মানুষেরা তা ভালোই জানেন। গার্ডেনরিচে বিল্ডিং বিপর্যয়ের পর পরিবেশবিদ নব দত্ত একটি চ্যানেলে বলেছেন, গার্ডেনরিচ এলাকায় নব্বুই শতাংশ বাড়িই তৈরি হয়েছে পুকুর বুজিয়ে।

কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলর থেকে ঊর্ধ্বতনদের রোজগারের মূল উৎস‌ই তো নির্মাণ খাত। যত নির্মাণ তত ইনকাম। কর্পোরেশনকে টাকা না খাইয়ে কেউ কখনও বিল্ডিংয়ের প্ল্যান পাশ করাতে পেরেছে? টাকা খাওয়ালে বেআইনিকে আইনি পরিণত করতে কতক্ষণ লাগে, তা কলকাতা শহরের সমস্ত প্রোমোটারের জানা আছে। যে নির্মাণ যত বেশি বেআইনি, সেখান থেকে রোজগার তত বেশি। আইনি-বেআইনি প্রত্যেকটা নির্মাণের খবর সবার আগে পান স্থানীয় কাউন্সিলর। কাউন্সিলরের মাধ্যমেই খবরাখবর যায় কর্পোরেশন ভবনের তলায় তলায়। টাকাপয়সার ভাগবাটোয়ারায় মধ্যস্থতা করাই এখন কাউন্সিলরদের সবথেকে বড় দায়িত্ব। শুধু কখন‌ও কোন‌ও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে আসমান থেকে পড়েন ফিরহাদ হাকিমরা।

বামে ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর শামস ইকবাল, পাশে ভেঙে পড়া বিল্ডিংয়ের প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিম। ছবিটি সংগৃহীত

ফিরহাদ হাকিম শুধু দুঁদে রাজনীতিবিদ‌ই না ভাল অভিনেতাও। তিনি সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হলে কলকাতার নাগরিকদের সেবা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে পারেন। বেআইনি বাড়ি ভেঙে লোক মারা গেলে সব দায় সামাজিক অবক্ষয়ের বলে নিজে ‘ফেরেশতা’ সাজতে পারেন। অথচ কলকাতা শহরের একটা বাচ্চাও জানে, শহরের প্রত্যেকটা বেআইনি নির্মাণের ব্যাপারে ফিরহাদ সব জানেন। গার্ডেনরিচের ভেঙে পড়া বিল্ডিংয়ের মালিক মহম্মদ সরফরাজ গ্রেফতার হয়েছেন। প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিম‌ও গ্রেফতার। এইসব তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হচ্ছে আই ওয়াশ। দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এমন করতে হয়। তিন-চারমাস পরে দুটোই জামিন পাবে। ততদিনে গার্ডেনরিচ অঞ্চলে আরও তিরিশটি বেআইনি বহুতলের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।

শুধু শিয়রে লোকসভা নির্বাচন থাকায় ফিরহাদ হাকিমের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে কিঞ্চিত অনিশ্চিয়তা আছে। সংবাদ মাধ্যমের সামনে ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষের বক্তব্য বেসুরো ঠেকছে। তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ডের সঙ্গে হাকিমের সম্পর্ক মধুর নয়। এতবড় একটা বিপর্যয়ের পর দায় মাথায় নিয়ে মেয়র স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন, এটা কল্পনারও অতীত। তবে এই ডামাডোলে তৃণমূলের ভেতরে ফিরহাদের সুহৃদরা ফিরহাদকে কোনঠাসা করতে সক্রিয় হতে পারে। অভিষেক লবি হাকিমকে অপসারণে তৎপরতা শুরু করলে অবাক হব না।

Feature graphic is representational and created by NNDC.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *