কলকাতা: গুঞ্জন সত্যি করে দল ছাড়লেন বরাহনগরের তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়। সোমবার দুপুরে নিজের বাড়িতে সাংবাদিকদের ডেকে তৃণমূল ছাড়ার কথা ঘোষণা করেন তাপস। তিনি বলেন, “আর যাই হোক, তৃণমূল দলটা আমার জন্য নয়।” দুর্নীতি, সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহানের মতো নেতার উত্থান এবং সেখানে নারী নির্যাতনের ঘটনা তাঁর দলত্যাগের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করে তাপস রায় জানান, “এখানে কিছু মানুষের জন্য সকলকেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। যেখানেই গিয়েছি, দুর্নীতির কথা শুনেছি। সন্দেশখালি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আমি বিড়ম্বনায় পড়েছি।’’ তাপস দুর্নীতি ও সন্দেশখালির কথা বললেও দলের ভেতরে অবহেলাই যে তাঁকে বিদ্রোহী করে তুলেছে, তা রাজনৈতিক মহলের অজানা নয়। এদিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে সে নিয়েও ক্ষোভ উগড়ে দেন তাপস রায়।
কুণাল ঘোষের মতোই সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একদমই বনিবনা নেই তাপস রায়ের। লোকসভা নির্বাচনের মুখে এই দু’জনের সঙ্গেই সুদীপের বিরোধ চরমে উঠেছে। দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও প্রবীণ এই নেতাকে কখনও মন্ত্রিসভায় জায়গা দেন নি মমতা। যদিও যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতায় তৃণমূলের অনেক নেতার থেকেই এগিয়ে তাপস। পুরনিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাপস রায়ের বাড়িতে ইডির ‘রেইড’ হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনও দুর্নীতির অভিযোগও শোনা যায় নি। গত ১২ জানুয়ারি সকালে তাপসের বাড়িতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-এর আধিকারিকেরা অভিযান চালিয়েছিলেন। দলের একাংশের ষড়যন্ত্রেই সে’দিন তাঁর বাড়িতে ইডির তল্লাশি হয়েছিল বলে সোমবার অভিযোগ করলেন তাপস রায়।
ঘটনার ৫২ দিন পরেও এই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মুখ না খোলায় তিনি মর্মাহত হয়েছেন বলেও জানান তাপস। তাঁর বাড়িতে ইডির অভিযানের খবর শুনে দলের অনেকেই খুশি হয়েছিলেন উল্লেখ করে তাপস রায় বলেন, “আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে শুনেছি, আমার বাড়িতে ইডির অভিযানের নেপথ্যে দলেরই কেউ কেউ রয়েছে। এটা দুঃখের বিষয়, বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ভাষণ দিলেন, তিনি সন্দেশখালির শাহজাহানের কথা বললেন। কিন্তু আমার কথা উল্লেখ করলেন না। আমি আশা করেছিলাম উনি আমার বাড়িতে ইডি অভিযানের কথা এক বার হলেও বলবেন। যেমন বাকিদের ক্ষেত্রে বলে থাকেন। এতে আমি আঘাত পেয়েছি।’’ প্রবীণ নেতা আরও বলেন, ‘‘রাজনীতিতে আমার সততা কারও অজানা নয়। নিজের দলের লোকই যদি আমার বিরুদ্ধে চলে যায়, সেটা দুর্ভাগ্যের। আমার বাড়িতে একটা সাজানো ইডি অভিযান হল, ৫২ দিন পেরিয়ে গিয়েছে। আমি এখনও মমতার ডাক পাইনি। আমার হৃদয়কে এটা ভারাক্রান্ত করেছে।’’
দল ছাড়ার ঘোষণা পরপরই বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিধানসভায় যান বরাহনগরের বিধায়ক। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে পদত্যাগপত্র তুলে দিয়ে এসেছেন তিনি। তাপস রায় ছিলেন বিধানসভায় তৃণমূল পরিষদীয় দলের উপমুখ্যসচেতক। বিধানসভা থেকে বেরিয়েই ফের সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তাপস। তিনি বলেন, ‘‘আমি বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। স্পিকারের সামনে সই করে ইস্তফা দেওয়ার নিয়ম। সে ভাবেই করেছি। ১ তারিখেই আমি দলের সব পদ ছেড়ে দিয়েছি। দলনেত্রী এবং সুব্রত বক্সীকে সে কথা জানিয়েছি।’’ তাপস রায় যে তৃণমূল ছাড়তে পারেন, অনেক দিন ধরেই এই কানাঘুষো চলছিল। সম্প্রতি এই গুঞ্জন তীব্র হতেই তাঁকে ধরে রাখতে আসরে নামেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। তৃণমূলে থাকতে কুণাল ঘোষের মতোই অভিষেক শিবিরের লোক ছিলেন তাপস। শোনা যাচ্ছে, উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে দলের মনোনয়নের দাবিদার ছিলেন তিনি। কিন্তু সুদীপকে প্রার্থী না করার কোনও আভাস কালীঘাট থেকে এখনও ভেসে ওঠে নি। এই পরিস্থিতিতে মমতার কাছ থেকে কল্কে না পেয়েই তাপস রায় দল ছাড়লেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সোমবার সকালে তাপস রায়ের বাড়ি গিয়েছিলেন মন্ত্রী ব্রাত্য বসু ও কুণাল ঘোষ। তাপসের মানভঞ্জনেই তাঁদের পাঠানো হয়েছিল বলে খবর। যদিও তৃণমূলের ভেতরে কুণালের নিজেরই পরিস্থিতি ভাল নয়। প্রকাশ্যে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিষোদ্গার করে কুণালের মুখপাত্র পদ গেছে। তাঁর বাড়িতে থাকার সময়ই কুণাল সুব্রত বক্সীর কাছ থেকে শোকজের চিঠি পান বলে জানিয়েছেন তাপস রায়।
তৃণমূলের সঙ্গে দীর্ঘ ২৩-২৪ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করার পর তাপস রায়ের পরবর্তী গন্তব্য কোথায়, তা নিয়ে জোর জল্পনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। এদিন তাপস নিজে বলেছেন, “রাজনীতি রাজনীতির পথেই হবে। আমি এখন মুক্ত। কোন দলে যোগ দেব, তা জানি না। অন্য দলে যোগদানের বিষয়ে এখন কোনও কথা আমি বলব না।’’ যদিও একটি মহল থেকে শোনা যাচ্ছে, তাপস রায়ের বিজেপিতে যোগদানের ক্ষেত্র প্রায় প্রস্তুত। উত্তর কলকাতা থেকে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তাপসকে পদ্মশিবির প্রার্থী করতে পারে বলে খবর রটেছে বাজারে। তাপসের দলত্যাগের দিনেই শোকজ লেটার পেলেন কুণাল। তাই শুধু তাপস রায় নয় কুণালের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রবল জল্পনা শুরু হয়ে গেছে।
Feature graphic is representational and created by NNDC.