ফিচারটি যদি আপনি না পড়ে ৬ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে দেখে নিতে চান, তবে নিচের এমবেডেড ভিডিওটিতে নজর রাখুন-
ইনফোয়ানা ফিচার: মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু অকাল মৃত্যু এবং রোগ-জরা-বার্ধক্যে ধুঁকতে ধুঁকতে দুনিয়া থেকে চিরবিদায়কে কে না ভয় পায়! আসলে দীর্ঘ কিন্তু সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবনই পৃথিবীর সকল মানুষের পরম প্রত্যাশা। খ্যাপা যেভাবে পরশপাথর খুঁজে ফেরে ঠিক সেভাবেই দূষণ-হিংসা ও হানাহানিতে বিদীর্ণ এই ধরিত্রীতে হন্যে হয়ে আনন্দময় দীর্ঘ জীবনের চাবিকাঠি খুঁজে বেড়াচ্ছে মানুষ।
ড্যান বুয়েটনারের ‘ফাইভ ব্লু জোন’
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যান বুয়েটনার তাঁর দলবল নিয়ে কুড়ি বছর ধরে সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়ে পাঁচটি এমন অঞ্চলের সন্ধান পেয়েছেন, যেখানে শতবর্ষী মানুষের শতাংশ বাকি পৃথিবীর থেকে অনেকটাই বেশি। এই পাঁচটি অঞ্চলকে ‘ব্লু জোন’ বলে চিহ্নিত করেছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।
প্রথমেই এই পাঁচ ব্লু জোনের লিস্টটা জানিয়ে রাখা যাক। নাম্বার ওয়ান- ইতালির সারডিয়ানা। নাম্বার টু- কোস্টারিকার নিকোয়া। নাম্বার থ্রি- জাপানের ওকিনাওয়া। নাম্বার ফোর- গ্রিসের ইকারিয়া। নাম্বার ফাইভ- আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার লোমা লিন্ডা।
ওকিনাওয়া: প্রতি ১ লক্ষে ৬৮ শতায়ু যেখানে
ইনফোয়ানার ‘ব্লু জোন’ পর্ব শুরু হচ্ছে আমাদের এশিয়া মহাদেশের জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের কাহিনী দিয়েই। পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যক দীর্ঘজীবী মহিলাদের বাসস্থান হিসেবে জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জকে শনাক্ত করেছেন গবেষক ড্যান বুয়েটনার। প্রশান্ত মহাসাগর ও পূর্ব চিন সাগরের মাঝে অবস্থিত ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের মনোরম সমুদ্র সৈকতে পা রাখলে আপনার নজরে আসবে ধবধবে সাদাবালু আর স্বচ্ছ জল। ১৫০টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ। ওকিনাওয়ায় প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যায় এমন ৬৮জনের খোঁজ মেলে জীবনের পিচে নটআউট থেকে যাঁরা ১০০ রান তুলেছেন। অর্থাৎ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন।
ওকিনাওয়ানরা শুধু দীর্ঘদিনই বাঁচেন না, তাঁরা প্রায় নিরোগ দেহের অধিকারী এবং বৃদ্ধদের অধিকাংশই পরিশ্রমী ও কর্মক্ষম। জাপান জুড়েই দীর্ঘজীবী মানুষের সংখ্যা অনেক কিন্তু ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের গড় আয়ু বাকি জাপানিদের থেকেও বেশি। তাঁর ‘দ্য ব্লু জোন সলিউশনস’ বইয়ে বুয়েটনার জানিয়েছেন, জাপানের অন্যান্য অঞ্চলগুলির অধিবাসীদর চেয়ে ওকিনাওয়ার মানুষের ১০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ বেশি।
জাতিসংঘের সমীক্ষা বলছে বর্তমান বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু ৭৩.১৬ বছর। সেখানে ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের মহিলাদের গড় আয়ু বাকিদের ঈর্ষা করার মতোই। ওকিনাওয়ার মহিলারা গড়ে ৮৭.৪৪ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকেন। পুরুষেরা খানিকটা পিছিয়ে ৮০.২৭ বছর। এই কারণেই সারা পৃথিবীর কাছে ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জ পরিচিত ” the land of immortals” নামে। ওকিনাওয়ানদের দীর্ঘ জীবনের কিছু ‘সিক্রেটস’ আমাদের সামনে এনেছেন ড্যান বুয়েটনার, হেক্টর গার্সিয়া, ফ্রান্সিস মিরেলস ও ড্রু বিনস্কির মতো অনুসন্ধানকারী সাংবাদিক,গবেষক, লেখক ও ব্লগারেরা।
‘হারা হাচি বু’ অর্থাৎ পেট কুড়ি শতাংশ ফাঁকা রেখো
গবেষকরা জানাচ্ছেন, ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের মানুষের খাদ্যাভাস ও জীবনযাপনের সংস্কৃতি বা লাইফস্টাইলই তাঁদের দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আসল কারণ। পাশাপাশি ওকিনাওয়ার রৌদ্রজ্জ্বল ঝরঝরে গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহাওয়া ও বিশুদ্ধ বাতাসও সেখানকার বাসিন্দাদের পরমায়ু বাড়িয়ে দিয়েছে। ওকিনাওয়ার মানুষের জীবনের মূলমন্ত্র- ‘ইক-ই-গাই’ (Ick-ee-guy)। অর্থাৎ তোমার জীবনের লক্ষ্য কী, তুমিই সেটা খুঁজে নাও। জীবনের লক্ষ্য খুঁজে নিয়ে জীবনযাপন, সকলে মিলেমিশে আনন্দে থাকা, বিশুদ্ধ খাদ্য গ্রহণ, পরিমিত আহার এবং কুঁড়েমি ত্যাগ করে পরিশ্রম- এই সবই হল ওকিনাওয়ার বাসিন্দাদের দীর্ঘজীবী হওয়ার সিক্রেটস।
ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের ঠাকুমারা কিন্তু নাতি-নাতনিদের মোটেই ভরপেট খাওয়ান না। আসলে পাকস্থলী ৮০ শতাংশ পূর্ণ হলেই খাওয়া থামিয়ে দেওয়া নিয়ম এই দেশে। ভোজের আসরে বসে খাদ্য গ্রহণের পূর্বে ওকিনাওয়ানরা একটি মন্ত্র উচ্চারণ করেন-‘হারা হাচি বু’। এই মন্ত্র বাংলা করলে মোদ্দা কথা যা দাঁড়ায়, “পেট কুড়ি শতাংশ ফাঁকা থাকতেই উঠে পড়তে ভুলো না।” দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্য ওকিনাওয়ার মানুষজন পেট ফাঁকা রেখেই খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়েন। ভাবা যায় মশাই! বাঙালি শ্বশুর খাবার পাতে জামাইয়ের কানে ‘হারা হাচি বু’ ঝাড়লে দক্ষযজ্ঞের আশঙ্কা পর্যন্ত উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
শাকসবজি খেয়েই শতায়ু ওকিনাওয়ানরা
এবার দেখে নেওয়া যাক ওকিনাওয়ানদের ডায়েট চার্টে কী থাকে। ওকিনাওয়ার মানুষের পছন্দের তালিকায় রয়েছে সামুদ্রিক শৈবাল এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তাজা শাকসবজি। দ্বীপে বসবাস করার পরেও মাছে তাদের তেমন রুচি নেই। ওকিনাওয়ানদের খাদ্য তালিকায় মাংসের পরিমাণও সামান্য। অবশ্য পর্ক প্রিয়। কিন্তু সেটাও নিজের খামারে পালিত শুকর থেকে সংগৃহীত। তাদের খাদ্য তালিকায় ডিম ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের স্থানও ১ শতাংশ মাত্র। আসলে ‘ট্র্যাডিশনাল ওকিনাওয়ান ডায়েটের’ ৯০ শতাংশই উদ্ভিদ ভিত্তিক, যার অধিকাংশই আবার বিভিন্ন ধরণের বিনস জাতীয় খাবার। ভাত বা নুডলস জাতীয় কার্বহাইড্রেট খাদ্য পরিমিত আহার করে থাকেন তাঁরা।
ওকিনাওয়ার মানুষের সবথেকে পছন্দের খাবার হল বেগুনি ও কমলা রঙের এক জাতীয় মিষ্টিআলু। তাদের ক্যালরির অধিকাংশই আসে এই মিষ্টিআলু থেকে। অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও প্রদাহরোধী এই খাদ্যই ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের সুস্থ দেহে দীর্ঘজীবী হওয়ার একটা অন্যতম কারণ বলে মানছেন গবেষকেরা।
মিলেমিশে থাকো এবং কাজের মধ্যে থাকো
শৈশবেই সন্তানদের মিলেমিশে বাঁচতে শেখান ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হলেই চার-পাঁচজনের এক-একটি বন্ধুগোষ্ঠীতে তাদের ভাগ করে দেওয়াই রেওয়াজ ওকিনাওয়ায়। এই গোষ্ঠীগুলিকে জাপানি ভাষায় বলা হয় ‘মোয়াই’। মোয়াই আসলে দ্বিতীয় পরিবারের ভূমিকা পালন করে সদস্যদের কাছে। বন্ধুদের সান্নিধ্য একাকীত্ব দূর করে। দরকারে মেলে মেন্টাল সাপোর্ট এমনকি আর্থিক সাহায্যও। মোয়াই থেকেই একে-অপরকে সহযোগিতার মাধ্যমে বেঁচে থাকার কৌশল রপ্ত করে ফেলেন ওকিনাওয়ার যুবক-যুবতীরা।
জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জ ফুলের দেশ। বাগান দেখলে জুড়িয়ে যায় চোখ। গার্ডেনিং ওকিনাওয়ানদের জন্য নিছক শখ নয় বরং দৈনন্দিন জীবনযাপনের অঙ্গ। প্রবীণেরাও সকালে উঠে বাগানের কাজে সময় দেন। এমনকি শতবর্ষীয়রাও বাগান থেকে নড়েন না। এক কথায় ওকিনাওয়ান লাইফস্টাইল মানেই নিয়মে চলা, মিলেমিশে বাঁচা, কাজের মধ্যে থাকা এবং অতিভোজন থেকে দূরে থাকা। আসলে সহজ, শুদ্ধ ও সুন্দরের সঙ্গে জীবনের নিবিড় যোগই ওকিনাওয়ার মানুষকে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের স্বাদ দিয়েছে।
Feature graphic is symbolic and created by ukd.
Video credit: Infoyana YouTube channel.