পলিটিক্যাল ডেস্ক: তৃণমূল কংগ্রেসে গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেছে, এ কথা বলার মতো সময় অবশ্যই আসে নি। তবে কুণাল ঘোষের কথা মতো দলটির ভেতরে ‘মমতা দি ও অভিষেক’ আবহ তৈরি না হয়ে ‘মমতা দি বনাম অভিষেক’ পরিস্থিতির যে সৃষ্টি হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তৃণমূলে মমতাপন্থী বনাম অভিষেকপন্থীদের লড়াই যে বেশ পেকে উঠেছে, শুক্রবার একটি জনপ্রিয় বাংলা সংবাদ চ্যানেলে বেশ ঘটা করেই জানান দিলেন কুণাল ঘোষ। কুণাল তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক ও মুখপাত্র। ঘরের কথা পরে ভাল করেই জানুক, এই উদ্দেশ্যেই পরিকল্পনা মাফিক সংবাদ মাধ্যমের সামনে মুখ খুলেছেন কুণাল। সামাজিক মাধ্যমে কুণাল ঘোষের বৃহস্পতিবারের পোস্টেই সেই ইঙ্গিত ছিল।
রাজনৈতিক মহল কিছুদিন ধরেই আভাস পাচ্ছিল, তৃণমূলের ভেতরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ স্বস্তিতে নেই। সংগঠনের কাজে অতি সক্রিয় অভিষেক হঠাৎ আড়ালে চলে যাওয়ার লোকজনের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের বিশেষ অধিবেশনে অভিষেক শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিলেন না। ভার্চুয়াল মাধ্যমে খানিকটা সময় হাজিরা দিয়ে দায় সেরেছেন। তাঁর চোখে সমস্যা ছিল বলে দল থেকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তাতে মঞ্চে লাগানো ব্যানারে অভিষেকের ছবি উধাও হয়ে যাওয়ার কথা নয়। অভিষেকই দলের ভবিষ্যৎ কান্ডারী, এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর থেকে তৃণমূলে এমন একটি অনুষ্ঠানও হয় নি যেখানে মমতার পাশে অভিষেকের ছবি স্থান পায় নি। বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরের সভার সামগ্রিক আবহ ও মমতার মেজাজ দেখার পর দুয়ে দুয়ে চার করতে মানুষের অসুবিধা হয় নি। তবে যা ছিল চাপা গুঞ্জন, তা ঢাক বাজিয়েই ভরা হাটে ফাঁস করে দিলেন খোদ তৃণমূলের মুখপাত্র। এ’দিন যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে চ্যানেলটিতে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কুণাল, তাতে কারোরই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, কার ইশারায় এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন তিনি।
এতদিন মনে হচ্ছিল তৃণমূলে সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ প্রায় নিজের হাতেই নিয়ে নিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের ভেতরে যাঁরা চান না যে অভিষেক সব ব্যাপারেই ছড়ি ঘোরাক, তাঁরাই মমতাপন্থী নামে পরিচিত। বলা বাহুল্য, এঁদের অধিকাংশই দলের পুরোনো নেতা এবং কেউ কেউ মমতার দুর্দিনের সাথী। সাম্প্রতিক সময়ে তৃণমূলের অন্দরে মমতাপন্থীদের কোনঠাসা হওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে। দল ছাপিয়ে রাজ্যের প্রশাসনেও অভিষেকের নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় হচ্ছিল বলে কানাঘুষো। অভিষেকের দৃষ্টি নাকি এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভায়। বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক রেশন দুর্নীতি মামলায় ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর বাতাসে
অনেক কথাই ভাসছে। পার্থর মতোই বালুর মন্ত্রিত্বের নাশ চান অভিষেক। ভাইপোর চাপ অগ্রাহ্য করেই বালুকে ক্যাবিনেটে বহাল রেখেছেন মমতা। ববি-অরূপও স্বস্তিতে নেই। তাঁদের অস্বস্তির কারণ একজনই- অভিষেক।
তৃণমূলের বিশেষ অধিবেশনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা থেকে পরিষ্কার- এখনই দলের রাশ ভাইপোর হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নন তিনি। লোকসভা নির্বাচনের আগে পিসি-ভাইপোতে ঠোকাঠুকির কারণ কী হতে পারে, তার একটা ইঙ্গিত কুণাল ঘোষ সাক্ষাৎকারে দিয়েছেন। দলের প্রার্থীতালিকা তৈরিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বড় রকমের হস্তক্ষেপ করতে চান বলে খবর। তৃণমূলের বর্তমান সাংসদদের অনেকেই অভিষেকের অপছন্দের তালিকায়। তাঁদের ছেঁটে ফেলে নতুনদের বলা ভাল নিজের অনুগামীদের মনোনয়ন দিতে চান তিনি। সম্ভবত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাইপোকে সেই সুযোগটি আর দিতে চান না। নেতাজি ইন্ডোরে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণে তেমন ইঙ্গিত আছে। পিসির কাছ থেকে সংকেত আগেই পেয়েছেন অভিষেক। তাই নিজেকে আড়াল করে কুণাল ঘোষকে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন। দল পরিচালনা নিয়ে কালীঘাট আর ক্যামাক স্ট্রিটে যে বড় ধরণের বিরোধ দেখা দিয়েছে, কুণাল তা খোলসা করেছেন।
এই বিরোধ কতটা গভীর এবং কতদূর পর্যন্ত যাবে তা এখনই বলা শক্ত। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ যে’ভাবে চ্যানেলে মুখ খুলেছেন সেটা দলদ্রোহের পর্যায়েই পড়ে। শুক্রবার কুণালকে তৃণমূলের নয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখপাত্র বলে মনে হচ্ছিল। অভিষেকের না বলা কথাগুলিই যেন ক্যামেরার সামনে উগড়ে দিলেন তিনি। নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ সভায় অভিষেকের ছবি না থাকার বিষয়টি লঘু করে দেখার সুযোগ নেই। ঘটনায় প্রকাশ্যেই অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন কুণাল। কুণাল চান, “মমতাদিই দলের নেতৃত্ব দিন। অভিষেক হোন তাঁর প্রধান সেনাপতি।” এতদিন তো সবাই তাই জানত। তবে কি তৃণমূলে অভিষেকের সেনাপতিত্ব যায় যায় নাকি চলেই গিয়েছে?
Feature graphic is representational.