আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মঙ্গলবার রাতে গাজার ‘আল আহলি ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালে’ রকেট মারল কে? হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ইজরায়েলের যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা বোমাতেই বিধ্বস্ত হয়েছে হাসপাতালটি। যদিও ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী-আইডিএফ অভিযোগ খারিজ করে পাল্টা দাবি করেছে, গাজা ভূখন্ড থেকে ছোঁড়া রকেটই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আল আহলি ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে পড়েছে। ঘটনায় ৫০০ অসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে বলে গাজা ভূখন্ডের হামাস নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে। যদিও অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস সহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, মৃতের সংখ্যা ২০০ থেকে ৩০০-র মধ্যে।
গাজার হাসপাতালে হামলার ঘটনায় ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তোলার সুযোগ পেয়েছে হামাস ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত এলাকার কর্তৃপক্ষ। প্রতিবেশী ইজিপ্ট, সৌদি আরব, জর্ডন ও তুরস্ক সহ আরব ও মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশের তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষের মুখে পড়তে হয়েছে তেল আভিভকে। গত ৭ অক্টোবর ভোরে হামাসের হাতে ইজরায়েল আক্রান্ত হওয়ার পর যুদ্ধ এগার দিনে গড়িয়েছে। বুধবার সকালে জরুরি সফরে ইজরায়েলে এসে পৌঁছেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করবেন বাইডেন। সফরকালে ইজরায়েল-হামাস সংঘাতের অবসানে জর্ডনের রাজধানী আম্মানে বাদশাহ আবদুল্লা, মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ সিসি ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গেও বৈঠকের পরিকল্পনা ছিল বাইডেনের। কিন্তু গাজার হাসপাতালে ইজরায়েলের বিমান হামলার অভিযোগে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে দিয়েছে জর্ডন।
আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, গাজার আল আহলি হাসপাতালে ৩০০ অসামরিক মানুষের মৃত্যুর দায় কার? ঘটনার পরপরই মঙ্গলবার রাতে একটি ছোট ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে আইডিএফ দাবি করেছে, গাজার হাসপাতালে বোমা হামলার সঙ্গে তাদের যোগ নেই। ঘটনার সময় ওই এলাকায় তাদের বাহিনী কোনও অভিযান চালাচ্ছিল না বলে জানিয়েছেন আইডিএফ-এর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি। আইভিএফ কখনও হাসপাতালে বোমা ফেলে না দাবি করে রিয়ার অ্যাডমিরাল হাগারি বলেছেন, “তাদের ‘অপারেশনাল সিস্টেম’ পর্যালোচনা করে এই তথ্যই উঠে এসেছে যে, সেই সময় গাজা ভূখন্ডে তৎপর সন্ত্রাসবাদীরা ইজরায়েলের বিভিন্ন পরিকাঠামো লক্ষ্য করে গুচ্ছ গুচ্ছ রকেট ছুঁড়ছিল। আল আহলি হাসপাতালের খুব কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি রকেট হাসপাতাল চত্বরে আঘাত হানে।” বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাগারির দাবি, “ইসলামিক জিহাদের তরফ থেকে ইজরায়েলকে তাক করে ছোঁড়া রকেটই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গাজার হাসপাতালে আঘাত করেছে।”
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজা স্ট্রিপ থেকে দৈনিক গড়ে সাড়ে চারশ রকেট ছোঁড়া হচ্ছে বলে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে। এর মধ্যে অনেক রকেট ‘মিস ফায়ার’ হয়ে গাজা ভূখন্ডেই আঘাত করে ফিলিস্তিনিদের হতাহতের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আইডিএফ প্রচারিত ভিডিও ফুটেজগুলিতেও দেখা যাচ্ছে, গাজা থেকে ছোঁড়া রকেট ভুল উৎক্ষেপণের কারণে ফিলিস্তিনের বিভিন্ন এলাকাতেই আঘাত করছে। হামাস সহ অন্যান্য সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর রকেট হামলা প্রতিরোধে অত্যাধুনিক ‘আয়রন ডোম’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে ইজরায়েল। ৭ অক্টোবর ভোরে ইজরায়েলি ভূখন্ডে অতর্কিত স্থল অভিযানের আগে বিশ মিনিটে ৫ হাজার রকেট ছুঁড়েছিল হামাস। ‘আয়রন ডোম’ অনেক রকেট মাঝ আকাশে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হওয়ায় ইজরায়েলের বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সে’দিন হামাস অল্প সময়ের ব্যবধানে হাজার হাজার রকেট নিক্ষেপ করায় প্রযুক্তি ঠিকভাবে কাজ দেয় নি বলে জানিয়েছিলেন ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
গাজার হাসপাতালে ইজরায়েলের হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু পাল্টা বলেছেন, “সারা বিশ্ব জানে, আইডিএফ নয় গাজার হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে গাজার বর্বর সন্ত্রাসবাদীরাই। যারা নিষ্ঠুরভাবে আমাদের শিশুদের খুন করেছে, তারাই এখন নিজেদের শিশুদেরও একইভাবে খুন করছে।” গাজার হাসপাতালে হামলার দায় ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদীদের উপরে চাপিয়েছেন ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতি আইজ্যাক হারজগও। নিজের ভেরিফায়েড এক্স হ্যান্ডেলে প্রেসিডেন্ট হারজগ লিখেছেন, “যেখানে মানুষ জীবন রক্ষার জন্য গিয়ে থাকেন, গাজার একটি হাসপাতালে ইসলামিক জিহাদের ছোঁড়া মিশাইলে বহু ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে।” যে সমস্ত সংবাদ মাধ্যম হামাসের দেওয়া মিথ্যা সংবাদ যাচাই না করেই প্রচার করেছে তাদের ধিক্কার জানিয়ে ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতি লিখেছেন, “হামাস ও ইসলামিক জিহাদিদের বিতরিত মিথ্যা গলাধঃকরণ করে ফেলা মিডিয়ার জন্য লজ্জার। এই একুশ শতকে বিশ্বজুড়ে রক্তের উৎসব সম্প্রচার করা গাজার সেই ঘৃণ্য সন্ত্রাসবাদীদের জন্য লজ্জিত, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে নিরপরাধীদের রক্ত ঝড়ায়।”
গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইজরায়েলে হামাসের আক্রমণে ১৪০০ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর প্রশাসন। নিহতদের অধিকাংশই নিরপরাধ অসামরিক জনগণ। শিশুদেরও হামলাকারীরা রেহাই দেয় নি বলে ইজরায়েলের অভিযোগ। একটি অনুষ্ঠানস্থলেই ২৬০জনকে খুন করা হয়েছে। অপহরণ করা হয়েছে দেড়শো থেকে দুশোজনকে। নিহতদের মধ্যে ২৭ মার্কিন নাগরিক সহ বেশ কয়েকজন বিদেশি পর্যটকও আছেন। ইজরায়েলের পাল্টা হামলায় গাজা স্ট্রিপ বিধ্বস্ত। অবরুদ্ধ গাজায় অসংখ্য বহুতল মাটিতে মিশে গেছে। ইতিমধ্যেই ৭ লক্ষের বেশি গাজাবাসী বাস্তুচ্যুত। সবথেকে নিরাপদ স্থান মনে করে প্রাণ বাঁচাতে গাজার হাসপাতালগুলিতে আশ্রয় নিয়েছেন বহু অসামরিক মানুষ। এখন হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েও রেহাই মিলছে না তাদের। ইজরায়েলকে বড় আঘাত করতে গিয়ে গাজার সাধারণ মানুষকেই মহা বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে হামাস।
Feature image credit- AP/ The Times of Israel.