ধূপগুড়ি: মঙ্গলবার ধূপগুড়ি দেখল অবাধ ও শান্তিপূর্ণ উপনির্বাচন। শুধু ধূপগুড়ি কেন, গোটা বাংলাও দেখল, ছিটেফোঁটা অশান্তি ছাড়াও ভোট সম্ভব, যদি নিরাপত্তার রাশ থাকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে। ধূপগুড়ি উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ ঘিরে বড় কোনও অভিযোগ নেই কোনও শিবির থেকেই। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিকেল ৩টে পর্যন্ত ধূপগুড়িতে ভোট পড়েছে ৬৩.৪৫ শতাংশ। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে তপশিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত এই আসনে ভোট পড়েছিল ৮৬.৩৮ শতাংশ। উপনির্বাচনে ভোটের হার সাধারণ নির্বাচনের তুলনায় সাধারণত কমই থাকে। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলেছে। ধূপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচনে ভোটদানের যা ট্রেন্ড, তা দেখে রাজনৈতিক মহলের অনুমান, একুশকে ছুঁতে না পারলেও ভোটের হার ৮০ শতাংশের ধারেকাছেই থাকবে।
মাত্রই দু’মাস আগে বাংলায় গেছে পঞ্চায়েত নির্বাচন। পঞ্চায়েত নির্বাচনের খারাপ স্মৃতি এত তাড়াতাড়ি মানুষের মন থেকে মুছে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। ধূপগুড়ি ব্লকেও পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে বিস্তর অভিযোগ বিরোধীদের। আদালতের নির্দেশের পরেও বুথে বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী ঠিকভাবে মোতায়েন করা হয় নি। ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে গিয়েও তাঁরা ভোট দিতে পারেন নি বলে অনেক ভোটার অভিযোগ করেছিলেন। পঞ্চায়েত ভোটে বহু বুথে পুলিশের সামনেই অবাধে ছাপ্পা হয়েছিল বলে ধূপগুড়ির সাধারণ মানুষের অভিযোগ। উপনির্বাচনে একেবারেই ভিন্ন ছবি। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ধূপগুড়ি বিধানসভার অন্তর্গত যে’সব বুথ থেকে অশান্তির খবর এসেছিল, উপনির্বাচনের দিন সকাল থেকেই সে’সব বুথের পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যে লাইন দিয়ে বিনা উপদ্রবে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেছেন নাগরিকেরা।
মঙ্গলবার ধূপগুড়ি বিধানসভার ২৬০টি বুথেই ভোটগ্রহণ অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হওয়ার সব কৃতিত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদেরকেই দিচ্ছেন ভোটাররা। উপনির্বাচনে মোট ৩০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করেছে নির্বাচন কমিশন। বুথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুরোপুরি কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতেই ছেড়ে দিয়েছিল কমিশন। রাজ্য পুলিশকে শুধু ভোটারদের লাইন ঠিক করতে দেখা যায়। সকালের দিকে বৈরাতিগুড়ি হাইস্কুলের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে জলপাইগুড়ি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ওয়াদেং ভূটিয়ার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তে দেখা যায় বিজেপি প্রার্থী তাপসী রায়কে। তাপসী রায়ের অভিযোগ ছিল, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অমান্য করে বুথের ২০০ মিটারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে রাজ্য পুলিশ। ধূপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচন ঘিরে সারা দিনে এটাই ছিল সবথেকে বড় খবর।
লোকসভা নির্বাচনের ওয়ার্মআপ শুরু হয়ে গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজবংশী জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত উত্তরবঙ্গের ধূপগুড়ি উপনির্বাচন তৃণমূল, বিজেপি ও বাম-কংগ্রেস জোট, তিন শিবিরের জন্যই হয়ে উঠেছে ‘লিটমাস টেস্ট’। এক সময়ের বামদুর্গ ধূপগুড়ি আজ বিজেপির গড়। ৭৭ থেকে ১১- এখানে টানা জিতেছে সিপিএম। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমকে হারিয়ে ধূপগুড়িতে ঘাসফুল ফোটান মিতালি রায়। উনিশের লোকসভা থেকে ধূপগুড়ির রাজনৈতিক রঙ বদলে যায়। জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির ডঃ জয়ন্ত রায় ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ০৪ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। ১৭ হাজারেরও বেশি ভোটে ধূপগুড়ি বিধানসভা থেকে লিড নিয়েছিলেন তিনি। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিষ্ণুপদ রায়ের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হয় তৃণমূলের মিতালি রায়কে। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতলেও জয়ের মার্জিন নেমে এসেছিল ৪ হাজার ৩৫৫তে। বিষ্ণুপদ রায়ের আকস্মিক মৃত্যুতেই উপনির্বাচন হচ্ছে ধূপগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে।
যে কারণে বিজেপি ধূপগুড়ি ধরে রাখতে মরীয়া ঠিক সেই কারণেই আসনটি বিজেপির হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে আদাজল খেয়ে নেমেছিল তৃণমূল। ধূপগুড়ি উপনির্বাচন যারাই জিতবে, লোকসভা নির্বাচনের আগে বাড়তি অক্সিজেন পাবে তারা। বিজেপি প্রার্থী তাপসী রায় কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় শহিদ সিআরপিএফ জওয়ানের স্ত্রী। তৃণমূলের প্রার্থী অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র রায় ধূপগুড়ির সাংস্কৃতিক জগতের সুপরিচিত মুখ। জোটের তরফে সিপিএমের প্রার্থী ঈশ্বরচন্দ্র রায় পেশায় শিক্ষক ও ভাওয়াইয়া শিল্পী। রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার শেষ কটা দিন ধূপগুড়ির মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন। দু’দফায় প্রচারে এসেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। জোটের হয়ে প্রচার করে গিয়েছেন সেলিম ও অধীরও। ২ সেপ্টেম্বর ভোট প্রচারে এসে তিনমাসের মধ্যে ধূপগুড়িকে মহকুমা ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
তৃণমূলের সভায় অভিষেকের হাত ধরে ঘাসফুল শিবিরে যোগ দেন জলপাইগুড়ি জেলা বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দীপেন প্রামাণিক। রাত পোহাতেই ৩ সেপ্টেম্বর সকালে ধূপগুড়ি শহরে বিজেপির নির্বাচনী দফতরে গিয়ে সুকান্ত মজুমদারের হাত থেকে পদ্ম পতাকা নেন তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক মিতালি রায়। আগের দিন বিকেলে অভিষেকের মঞ্চেও ছিলেন মিতালি। ভোটের একেবারে শেষ মুহূর্তে দীপেন ও মিতালির ফুল বদলাবদলিতে কোন ফুলের লাভ হল আর কোন ফুলের ক্ষতি, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) দুপুর পর্যন্ত। জনগণের রায় এখন ইভিএমবন্দী। ফল জনতা জনার্দনের মর্জি অনুযায়ী যা হওয়ার তাই হবে কিন্তু ভোট নিয়ে কাউকেই অভিযোগ তোলার সুযোগ দিল না জাতীয় নির্বাচন কমিশন। সৌজন্যে অবশ্যই কেন্দ্রীয় বাহিনী। আরও একবার প্রমাণিত হল, বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকলেই বাংলায় শান্তিপূর্ণ ভোট সম্ভব!
Feature image- NNDT.