পঞ্চায়েত আইনে সবথেকে কম সময়ের মধ্যে ভোট করার যে বিধান আছে, সেই অনুযায়ী ভোটের বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপে আইনত কোনও ভুল নেই কিন্তু কমিশনের অভিপ্রায় বুঝতে মানুষের ভুল হচ্ছে না। লিখলেন উত্তম দেব-
যে ভোট নিয়ে মার্চ-এপ্রিল থেকে জল্পনা এবং হওয়ার কথা ছিল মে মাসে, সেই ভোট হতে চলেছে আগামী ৮ জুলাই। রাজ্য নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার বিকেলে আচমকা পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দেওয়ায় বিরোধীরা অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যদিও মনে করছেন, আচমকা কিছুই নয় পূর্ব পরিকল্পনা মতোই নবান্নের নির্দেশে পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘন্ট ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। পুরো ব্যাপারটাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পেটে পেটে ছিল। মমতা আগেই ভেবে রেখেছিলেন, নিজের সুবিধা মতো সময়ে নিজের পছন্দের নির্বাচন কমিশনারকে দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট করিয়ে নেবেন তিনি। প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীব সিনহাই সেই পছন্দের মানুষ এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই নবান্নের আজ্ঞা মেনে পঞ্চায়েত ভোটের ঢেঁড়া পিটিয়ে দিয়েছেন রাজীব।
আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে থাকলে হয়তো এপ্রিল-মে’তেই পঞ্চায়েত ভোট সেরে ফেলতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু নিয়োগ সহ নানা দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে গিয়ে গত বছরের ২১ জুলাইয়ের পর থেকেই চাপে সরকার এবং দল। পরিস্থিতি পঞ্চায়েত ভোটের জন্য কতটা অনুকুল, তেইশের শুরু থেকেই তা নিয়ে তৃণমূল সুপ্রিমোর মনে একটা সংশয় ছিলই। যখন মমতা জল মাপ ছিলেন, সেই সময়েই সাগরদিঘি থেকে এল দুঃসংবাদ। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত সাগরদিঘি বিধানসভার উপনির্বাচনে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন বিশ্বাসের কাছে ২৩ হাজার ভোটে পরাজিত হন তৃণমূলের দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয় ২ মার্চ। ৬৫ শতাংশ সংখ্যালঘুর কেন্দ্রে অপ্রত্যাশিত ধাক্কা খাওয়ার পর পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতি নেন মুখ্যমন্ত্রী। যখন বিরোধীরা ভাবতে শুরু করেছিলেন, বোর্ডের পরীক্ষাপর্ব মিটলেই এপ্রিলের শেষে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে যাবে, তখন অভিষেককে জনসংযোগ যাত্রায় নামিয়ে তাঁদের সেই আশায় কার্যত জল ঢেলে দেন মমতা। যদিও জনসংযোগ যাত্রা শেষ হওয়ার আগেই পঞ্চায়েত ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে গেল কিন্তু অভিষেক জনসংযোগ যাত্রায় থাকতে থাকতেই সাগরদিঘি উপনির্বাচনে জয়ী কংগ্রেসের একমাত্র বিধায়ককে ভাঙিয়ে নিয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো।
২৮ মে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে সৌরভ দাসের মেয়াদ শেষ হয়। ২৯ মে অভিষেকের হাত ধরে তৃণমূলে যোগ দেন বায়রন। তার আগেই নবান্ন ঠিক করে ফেলেছিল সৌরভের স্থলাভিসিক্ত হবেন মমতার অতি আস্থাভাজন রাজীব সিনহা। নবান্নের সঙ্গে রাজভবনের দ্বন্দ্বে রাজীবের নিয়োগ আটকে ছিল। ৭ জুন জট কাটতেই নির্বাচন কমিশনের দফতরে গিয়ে দায়িত্ব নেন রাজীব। দায়িত্ব গ্রহণের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ জানিয়ে দেন তিনি। পুরো ব্যাপারটাই যে ‘স্ক্রিপটেড’ বৃহস্পতিবার বিকেলের সাংবাদিক সম্মেলনে রাজীব সিনহার কথাতেই তা ফুটে উঠেছে। আইএএস রাজীব সিনহা রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব ও মুখ্যসচিবের দায়িত্ব সামলেছেন। দুঁদে আমলা। তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু তাঁর নিরপেক্ষতা সংশয়াতীত নয়।
দৃঢ় চরিত্রের কেউ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মাথায় বসুক, রাজ্য সরকারও কি তা চায়? ২০১৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল প্রাক্তন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডের অধীনে। দৃঢ়চেতা আইএএস মীরা ‘ইয়েস ম্যাম’ ছিলেন না। তিনি সরকারের মর্জি মাফিক নির্বাচন পরিচালনায় রাজি হন নি। সেই সময় একাধিক দফায় পঞ্চায়েত ভোট ও ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েনের জেরে রাজ্য নির্বাচন কমিশন আদালতে গিয়েছিল এবং মোকদ্দমা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। মীরা পান্ডের পর থেকেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে কাউকে বসানোর আগে তাঁর মেরুদন্ড ভালমতো পরীক্ষা করে নেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজীব এতটাই নির্ভরযোগ্য ও আস্থার পাত্র যে রাজীবের মেরুদন্ড পরীক্ষা করে দেখারও দরকার পড়ে নি। নিঃসন্দেহে মুখ্যমন্ত্রীর সবথেকে ‘ট্রাস্টেড’ আমলাই এখন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক সংস্থার শীর্ষে।
গ্রাম পঞ্চায়েতের ৬৩ হাজার ২৮৩, পঞ্চায়েত সমিতির ৯৭৩০ এবং জেলা পরিষদের ৯২৮টি আসনে ভোট হবে। মোট আসন সংখ্যা প্রায় ৭৪ হাজার। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন মানেই রাজনৈতিক হানাহানি। বাম আমলেও বিনা রক্তপাতে পঞ্চায়েত ভোট হয় নি। তবে আঠারোর পঞ্চায়েত নির্বাচন অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় থেকে বিরোধীদের মনোনয়ন জমায় বাধা। খুনোখুনি, বোমাবাজি, ছাপ্পা থেকে গণনায় কারচুপি- আঠারোর পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠলে তৃণমূলের নেতারা পর্যন্ত আমতা আমতা করেন। এই পরিস্থিতিতে গ্রামের ভোটদাতা জনগণ থেকে বিরোধী দলের প্রার্থীগণ, কেন তাঁর উপর আস্থা রাখবেন, সাংবাদিকদের সেই প্রশ্নের কোনও দৃঢ় ও স্পষ্ট জবাব কিন্তু নতুন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার দিতে পারেন নি। পঞ্চায়েত আইনে সবথেকে কম সময়ের মধ্যে ভোট করার যে বিধান আছে, সেই অনুযায়ী ভোটের বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপে আইনত কোনও ভুল নেই কিন্তু কমিশনের অভিপ্রায় পড়তে মানুষের ভুল হচ্ছে না। খলের কখনও ছলের অভাব হয় না। আদালত হস্তক্ষেপ না করলে অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। আশার কথা, আদালতও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অক্ষমতার বিষয়টা বুঝতে পেরেছে।
Feature image is representational.