পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে কি এখনও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি মুখ্যমন্ত্রী? ধোঁয়াশা কাটিয়ে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট কবে?লিখলেন নির্বাণ রায়-
মার্চ থেকেই পঞ্চায়েত ভোট এখন হয়, তখন হয় গুঞ্জন। কিন্তু এপ্রিল-মে পেরিয়ে জুনের প্রথম সপ্তাহ চলছে, রাজ্যে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন কবে, কেউ জানে না। বলা ভাল, একজন ছাড়া কেউ জানে না। তিনি লোকসভা নির্বাচনের আগে পঞ্চায়েত ভোট আদৌ করাতে ইচ্ছুক কিনা, এখন এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে উঠেছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনা করবে যে রাজ্য নির্বাচন কমিশন, সেই দফতরের সর্বোচ্চ কর্তার চেয়ারটি ফাঁকা নয়দিন ধরে। গত ২৮ মে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সৌরভ দাস অবসর নিয়েছেন। এখনও সৌরভের স্থলাভিসিক্ত কেউ হন নি। নবান্ন ও রাজভবনের টানাপোড়েনে নতুন রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ ঝুলে রয়েছে। এই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী মুখে উষ্মা প্রকাশ করলেও জট কাটাতে আদৌ তিনি আন্তরিক কিনা, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে।
স্থানীয় সরকার নিয়ে ছেলেখেলা!
পঞ্চায়েত ও পুরসভা ভোট কবে কখন হবে, তা নির্ধারণ করার রাজ্য নির্বাচন কমিশন কেউ নয়। এই সংক্রান্ত আইনটি বাম জামানায় এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে কমিশনের ভূমিকা হয় ঠুঁটো জগন্নাথের। ১১তে পালাবদলের পর বামেদের করা আইনটির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বামেরা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনি ভিতটা রাজনৈতিক স্বার্থে দুর্বল করে গড়লেও পুরসভা ও পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কখনও গড়িমসি করে নি। কিন্তু তৃণমূলের আমলে সরকার পঞ্চায়েত নির্বাচন ও পুরসভাগুলির ভোট করাচ্ছে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো। হাওড়া শহরকে বলা হয় কলকাতার যমজ ভাই। রাজ্যের সচিবালয়ও হাওড়ার মাটিতে। এহেন গুরুত্বপূর্ণ শহরটির মাথায় সাড়ে চার বছর ধরে কোনও নির্বাচিত অভিভাবক নেই! হাওড়া পুর কর্পোরেশনের নির্বাচিত বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০১৮-র ১০ ডিসেম্বর। হাওড়া ও বালি পুরসভার পৃথকীকরণ বিল নিয়ে নবান্ন-রাজভবন টানাপোড়েনের জেরে দুই শহরেই পুরভোট অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত। রাজ্যে হাওড়া ও বালি ছাড়াও পাঁচ পুরসভায় দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচিত বোর্ড নেই।
রাজ্য নির্বাচন কমিশন অভিভাবকহীন কেন?
পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় হাওড়া ও বালি সহ সাত পুরসভার বকেয়া ভোটও সেরে ফেলা হবে বলে গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে শোনা গিয়েছিল। তেইশের জুনে এসে পঞ্চায়েত ভোট নিয়েই গভীর রহস্য আর সাত পুরসভার ভোট নিয়ে তো মুখ্যমন্ত্রীর মুখে কোনও উচ্চবাচ্যই শোনা যাচ্ছে না। অনেক ঘটনার পর আঠারোর পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল ১৪ মে তারিখে। পাঁচ বছর পর তেইশের জুন মাসে রাজ্য নির্বাচন কমিশনই অভিভাবকহীন! সৌরভ দাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ নিয়ে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে সরকারের যাতে কোনও সংঘাত না বাঁধে, সেই লক্ষ্যে নবান্নের তরফে কোনও আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল বলে মনে হয় না। প্রথমে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীব সিনহার নাম প্রস্তাব করে রাজভবনে পাঠায় সরকার। একটি মাত্র নাম দেখে রাজ্যপাল আপত্তি জানালে পরেরবার রাজীব সিনহার সঙ্গে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব অজিতরঞ্জন বর্ধনের নামও পাঠায় নবান্ন। কিন্তু প্যানেলে প্রথামাফিক তিনটি নাম চান রাজ্যপাল আনন্দ বোস। রাজভবনের সঙ্গে সংঘাত এড়ানোর সদিচ্ছা থাকলে প্রথমেই তিনটি নামের একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল পাঠাতে পারত নবান্ন।
মমতা কি সময়ে পঞ্চায়েত ভোট করতে আন্তরিক?
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সৌরভ দাসের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২৮ মে। পঞ্চায়েত নির্বাচন সম্পন্ন করে যাওয়ার পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিলেন সৌরভ দাস। সৌরভের আনুগত্য নিয়ে সরকার ও শাসকদলের দিক থেকে কোনও সংশয় না থাকলেও সৌরভ থাকতে থাকতেই পঞ্চায়েত ভোট করে ফেলার রাস্তায় হাঁটেন নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসলে কোন সময়ে পঞ্চায়েত ভোট করলে সব দিক দিয়েই সুবিধা হয়, সেটাই কি এখনও খুঁজে বের করতে পারেন নি তৃণমূল সুপ্রিমো? যখন পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার কথা তখনই দু’মাসের জন্য জনসংযোগ যাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেকের কর্মসূচি যে মমতারই মস্তিষ্কপ্রসূত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। জুনের শেষে অভিষেকের যাত্রা সাঙ্গ হবে। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোট কবে হবে?
জুলাই মাসেই হবে, এখনও পর্যন্ত এমন কোনও ছবি দেখছে না রাজনৈতিক মহল। যদিও গ্রামীণ ভোটের উত্তাপ শাসক-বিরোধী দুই শিবিরেই ছড়িয়েছে। জুলাই ফস্কে গেলে অগাষ্ট-সেপ্টেম্বরের ভরা বর্ষায় বাংলার গ্রামে গ্রামে ভোটের মাদল বেজে ওঠার কোনও সুযোগ নেই। প্রশাসন দুর্যোগ মোকাবিলায় নামবে না ভোট করাবে? গ্রাম বাংলার আবাদ করে খাওয়া মানুষ ক্ষেতে সময় দেবেন না ভোটে? অক্টোবর পূজার মাস। এ’বছর দুর্গাপূজা দেরিতে। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলায় উৎসব মরশুম। যে ভোট মে মাসেই হয়ে যাওয়ার কথা, তা জুনেও হচ্ছে না। জুলাই মাসে হওয়ারও নামগন্ধ নেই। ইতিমধ্যে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ নিয়েও জটিলতা বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। অগাষ্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কেন পঞ্চায়েত ভোট করা সম্ভব নয়, তা বাঙালি মাত্রেরই বোধগম্য। এরপরেও পঞ্চায়েত ভোট করা নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না?
ভাবমূর্তি বাঁচাতেই কি পঞ্চায়েত ভোটে বিলম্ব?
ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন ভালোয় ভালোয় শেষ করা মুখের কথা নয়। ৬২ হাজার ৪০৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ৯ হাজার ৪৯৮টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং ৯২৮টি জেলা পরিষদ সহ মোট ৭২ হাজার ৮৩০টি আসনে ভোট নিতে হবে। আঠারোর পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা,সন্ত্রাস ও ছাপ্পার আগুনে মুখ পুড়েছিল সরকার ও শাসকদলের। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে আবার যাতে প্রশাসন ও দলের মুখে চুনকালি না পড়ে, এই আশঙ্কাতেই কি পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না মুখ্যমন্ত্রী?
Feature Image is representational.