ক্ষমতায় না বসলে যে মানুষ চেনা যায় না অথবা ক্ষমতা যে চেনা মানুষকে অচেনা করে তোলে তার প্রমাণ ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই বছরের মাথায় দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।লিখলেন উত্তম দেব-
২০১১ তে ১০০ শতাংশ বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় বিধানসভা ভোট হয়েছিল বাংলায়। সেই ভোটে জিতে ৩৪ বছরের বাম শাসনকে উৎখাত করে ক্ষমতায় বসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এগারোর আগে যে মানুষটি প্রত্যেকটি ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবিতে সবথেকে বেশি সোচ্চার ছিলেন ক্ষমতায় বসার মাত্র দুই বছরের মধ্যেই সেই মানুষটির চোখের বালি হয়ে দাঁড়ায় কেন্দ্রীয় বাহিনী। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের চেয়ারে মীরা পান্ডে। মীরা পান্ডে একাধিক দফায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় পঞ্চায়েত ভোট করার প্রস্তুতি নিতেই বেঁকে বসেন মমতা। তৃণমূল সরকারের বয়েস মাত্র দুই। তখনও মমতার ক্যারিশ্মায় বিশেষ দাগ লাগে নি। অভিষেক রাজনীতি থেকে দূরে। তৃণমূলের সংগঠনের হাল মুকুল রায়ের হাতে। সারদা কেলেঙ্কারির ধামা উঠেছে বটে কিন্তু কুণাল ঘোষ কাঁদতে কাঁদতে রাজ্য পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন নি। মমতার জামানায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রথম বড় ভোট। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে সরকার।
ক্ষমতায় না বসলে যে মানুষ চেনা যায় না অথবা ক্ষমতা যে চেনা মানুষকে অচেনা করে তোলে তার প্রমাণ ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই বছরের মাথায় এইভাবেই দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতায় এসেই বাস্তববাদী তৃণমূল সুপ্রিমো বুঝে গিয়েছিলেন বুথে বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারি, বহু দফায় ভোট গ্রহণ এবং স্বাধীনচেতা একজন নির্বাচন কমিশনার- এইসব বিরোধী থাকা অবস্থায় খুবই দরকারি কিন্তু দল সরকারে থাকলে একদমই নয়। মীরা পান্ডে ছিলেন নাছোড়বান্দা। ভোটের দিনক্ষণ, দফা এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে সরকারের সঙ্গে কমিশনের বিবাদকে আদালতে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন মীরা। মামলা হাইকোর্ট ছাড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়। পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের থেকে কোনও অংশে কম নয়- মেনে নিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।
মীরা পান্ডের দৃঢ়তায় সেবারে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল পাঁচ দফায় এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায়। ৮০০ কোম্পানির বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যে এসেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন বলছিলেন, তেরোতেও কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল কিন্তু তাতে হিংসা আটকানো যায় নি। সত্যিই আটকানো যায় নি। শাসকদল না চাইলে সম্ভবও নয়। কিন্তু মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও জলপাইগুড়ি- তিনটি জেলা পরিষদে জয় পেয়েছিল বিরোধীরা। নির্বাচন স্বচ্ছ হলে বিরোধীরা বিজয়ী হয়, বিষয়টি তেমন নয়। বরং নির্বাচন স্বচ্ছ হলে জনগণ যা চায় গণনায় তার প্রতিফলন হয়। নিজের বিবেকের কাছে সৎ থেকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন মীরা পান্ডে। যদিও মমতার চোখে মীরার সৎ ও নির্ভীক আচরণ ঔদ্ধত্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
মেয়াদ শেষে মীরা পান্ডে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ছেড়ে গেলে মুখ্যমন্ত্রী কী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কে জানে! তবে এরপর রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মাথায় আর দ্বিতীয় মীরা পান্ডে পাই নি। মমতা কী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করে নিতে মানুষের অসুবিধা হয় না। কিছু লোক বাড়ি থেকে দফতরে রওনা দেওয়ার আগে শিরদাঁড়া খুলে দেরাজে রেখে আসেন কেউ কেউ আনেন সঙ্গে। মীরা পান্ডের পর যে ক’জন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের শীর্ষ পদে বসেছেন তাঁরা শিরদাঁড়া সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, এমন প্রমাণ আমরা পাই নি। তবে প্রাক্তন তিন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়, অমরেন্দ্র নাথ সিং ও সৌরভ দাসের সঙ্গে বর্তমান রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহার চরিত্রে গুণগত পার্থক্য আছে জানবেন। বাকি তিনজন ছিলেন স্বভাবভীরু। কিন্তু বর্তমানে যিনি বিরাজমান তিনি মুখ্যমন্ত্রীর একান্ত অনুগত এবং পরম আস্থাভাজন কিঙ্কর। নবারুণ ভট্টাচার্যের ভাষায় ‘আজ্ঞাবহ দাস’। নির্বাচন কমিশনারের মতো সাংবিধানিক পদে বসে লোকটা যা করে চলেছেন তাকে ঢ্যামনামি না বললে সত্যের অপলাপ হয়।
পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যের সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। হাইকোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দায়ের করা এসএলপি খারিজ করে হাইকোর্টের রায়কেই বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। বিরোধী দলের নেতারা ভেবেছিলেন, এই বার বুঝি সোজা হলেন রাজীব। মঙ্গলবার সূর্য ডোবার আগেই রাজীব সিনহার এক টোটকায় রাজ্যশুদ্ধ মানুষের চক্ষু চড়কগাছ। বাইশ জেলার জন্য বাইশ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীর সুপারিশ রাজ্যের কাছে পাঠিয়ে অম্লান বদনে দফতর ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠেন নির্বাচন কমিশনার। ঘটনাটি শুনে কমিশনের দফতরে উপস্থিত সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা পর্যন্ত টাস্কি খেয়ে গেছেন। কিন্তু চলন্ত গন্ধমাদন পর্বত মৌন এবং নির্বিকার। কতবড় মিচকে হারামি হলে সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়েও এমন খচরামি করা সম্ভব!
একজন তৃপ্তির হাসি চেপে রেখে মনে মনে বলছেন, কেমন স্যাম্পল জায়গা মতো পাঠিয়েছি, দ্যাখ।
Feature Image is Representationl.