কলকাতা: রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারির ২৪ ঘন্টার মধ্যেই আদালতে বিজেপি ও কংগ্রেস। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে শুক্রবার হাইকোর্ট খুলতেই জরুরী ভিত্তিতে মামলা শুনল প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় বৃদ্ধি ও পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন সহ বিরোধীদের দাবি পাঁচটি। বিরোধীদের দাবিকে মান্যতা দিয়ে ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, ছয়দিন মনোনয়ন পেশের জন্য যথেষ্ট নয়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বলেছে প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ।
মনোনয়ন জমা দিতে ২৪ ঘন্টা সময়!
বুধবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা। কোনও পূর্বাভাস ছাড়া বৃহস্পতিবার বিকেলেই মাত্র একদফায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে দিয়েছেন নতুন নির্বাচন কমিশনার। পাহাড়ে দ্বিস্তরীয় এবং শিলিগুড়ি মহকুমা বাদে রাজ্যের বাকি অংশে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রায় ৭৪ হাজার আসনে ভোট নেওয়া হবে আগামী ৮ জুলাই। বিরোধীদের প্রধান অভিযোগ মনোনয়ন নিয়ে। ৯ জুন (শুক্রবার) থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কাজ শুরু। চলবে ১৫ জুন (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত। নামে সাতদিন হলেও রবিবার সরকারি দফতরে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় মনোনয়ন জমা দেওয়া যাবে না। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ৩টার মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে। মনোনয়নপত্র জমা করার জন্য ছয়দিনে মাত্র ২৪ ঘন্টা সময় পাওয়া যাচ্ছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ।
আদালতের কাছে বিরোধীদের পাঁচদফা দাবি
মনোনয়ন জমা কালে এবং ভোটের দিনের নিরাপত্তা নিয়েও বিরোধীরা উদ্বিগ্ন। বৃহস্পতিবার ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার দিন সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশ্নের সুস্পষ্ট কোনও উত্তর দিতে পারেন নি নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা। দ্রুত সর্বদল বৈঠক আহ্বান, মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা বৃদ্ধি, মনোনয়ন জমা দেওয়ার কালে প্রার্থীদের নিরাপত্তা, ভোটগ্রহণ ও গণনা প্রক্রিয়ায় সিসি ক্যামেরার নজরদারি, বুথে ও গণনায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন এবং অনলাইনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা- এই পাঁচ দাবিতে হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন কংগ্রেস ও বিজেপির আইনজীবীরা।
মনোনয়ন জমার সময় বাড়াতে বলল আদালত
শুধু বিরোধী দলের নেতারাই নন বিচারপতিরাও যে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে উদ্বিগ্ন, তা ধরা পড়েছে মামলার শুনানি চলাকালে। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্য বলেন, “আদালত প্রাথমিকভাবে মনে করছে, রাজ্য নির্বাচন কমিশন মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য যে সময় দিয়েছে, তা উপযুক্ত নয়। ওই সময়সীমা আরও বাড়ানো উচিত।” প্রধান বিচারপতি রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন, “মনোনয়ন জমা থেকে ভোটগ্রহণ- পুরো সময়টি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে করা হয়েছে। মনোনয়নে সময় খুবই কম দেওয়া হয়েছে। ভোটের নির্ঘন্ট নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা উচিত কমিশনের।”
সিভিক নিয়ে কমিশনকে সতর্ক করল ডিভিশন বেঞ্চ
পঞ্চায়েত ভোটের নিরাপত্তা নিয়েও আদালত আশ্বস্ত হতে পারছে না। বিরোধীদের দাবি কেন্দ্রীয় বাহিনী। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে রাজ্যের সিদ্ধান্ত জানতে চায় ডিভিশন বেঞ্চ। বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ, প্রয়োজন মনে করলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারে রাজ্য পুলিশ। বিরোধীদের আশঙ্কা হাতে পর্যাপ্ত পুলিশ না থাকায় চুক্তি ভিত্তিক কর্মী ও সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের কাজ করাতে পারে রাজ্য সরকার। শুক্রবারের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলে দিয়েছেন, এই নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার ও কমিশন যেন অতীতে দেওয়া আদালতের নির্দেশ মেনে চলে। উল্লেখ্য ভোট সংক্রান্ত কোন কোন কাজে সিভিক পুলিশদের কাজে লাগানো যাবে, এই সংক্রান্ত ব্যাপারে আগেই একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা।
পঞ্চায়েত ভোটে প্রযুক্তির ব্যবহার চায় হাইকোর্ট
এদিন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ সরকার ও কমিশনকে জানায়, তারা মনে করছে, মামলাকারীর পঞ্চায়েত ভোট বন্ধ করতে নয় বরং ভোট প্রক্রিয়া অবাধ, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ করতেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। প্রধান বিচারপতি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “এখন তো বার অ্যাসোসিয়েশনের ভোটও ক্যামেরার নজরদারিতে হয়। তাহলে এত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে কেন সিসি ক্যামেরার ব্যবহার নিয়ে স্পষ্ট কোনও অবস্থান নেই কমিশনের?” তিনি বলেন, “প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে। পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া ভিডিও ক্যামেরার নজরদারিতে করা প্রয়োজন বলে মনে করি।” প্রধান বিচারপতি কমিশনের আইনজীবীর কাছে প্রশ্ন করেন, “অনলাইনে মনোনয়ন জমা নিতে কীসের অসুবিধা?” প্রধান বিচারপতি বলেন, “অনলাইন হলেই তো সুবিধা। কেউ সশরীরে যেতে না নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে তিনিও মনোনয়ন জমা দিতে পারবেন। স্ক্রুটিনি কত সহজ হয়ে যাবে।” নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীর উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন, “প্রযুক্তি ব্যবহারে আপনাদের এত এলার্জি কেন?” শুনানিতে প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম কমিশনের আইনজীবীকে মনে করিয়ে দেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।
পঞ্চায়েত ভোটেও আদালতই আশার আলো
আগামী সোমবার মামলার পরবর্তী শুনানি। সেদিন কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে রাজ্যকে এবং মনোনয়ন, সিসি টিভি সহ বাকি বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে তাদের অবস্থান জানানোর নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এখন দেখার পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় কতটুকু হস্তক্ষেপ করে আদালত এবং আদালতের হস্তক্ষেপের কারণে পঞ্চায়েত ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয় কিনা। তবে আপাতত হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে অবাধ ও সুষ্ঠু পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে আশার আলোই দেখছে বিরোধী শিবির।
Feature image is representational.