কলঙ্ক মোচনের সুযোগ এসেছে, মুখ্যমন্ত্রী কি সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন না? - nagariknewz.com

কলঙ্ক মোচনের সুযোগ এসেছে, মুখ্যমন্ত্রী কি সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন না?


ভাল কিছু করতে গেলে চাই সদিচ্ছা আর সাহস। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এই মুহূর্তে বাংলার প্রশাসনিক প্রধানের মধ্যে দুটোরই বড় আকাল। যিনি সরকার, প্রশাসন ও নাগরিকবৃন্দের নেতৃত্ব দেন, তিনিই যদি হীন স্বার্থের দাস হয়ে পড়েন, তবে নৈরাজ্য দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দুন্দুভি বেজে উঠেছে। পঞ্চায়েতিরাজ আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তি। পাঁচ বছর পর পর সব রাজ্যেই পঞ্চায়েত ভোট হয়। পশ্চিমবঙ্গেও হচ্ছে। কিন্তু বাংলায় পঞ্চায়েত ভোট এলেই গ্রামীণ জনজীবনে গণতন্ত্রের চর্চা বেগবান হ‌ওয়ার পরিবর্তে বোমাতন্ত্রের কারবার জোরদার হয়ে ওঠে। রাজ্যের দোর্দন্ডপ্রতাপ সরকার প্রধান মন থেকে চাইলে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে মানুষের উৎকন্ঠার অবসান ঘটানো কঠিন কোন‌ও ব্যাপার নয়। কিন্তু সহজ কাজটি করতে তাঁর খুবই আন্তরিক আগ্রহ আছে, এখনও পর্যন্ত এই প্রমাণ আমরা পাই নি।

প্রশাসনের মাথা সদাই হীন রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা প্ররোচিত হলে রাজধর্মের গঙ্গালাভ অনিবার্য হয়ে ওঠে। পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী যথার্থ রাজধর্ম পালনের পরিচয় দিতে পারলেন কি? গড়িমসি করতে করতে ভোটটাকে তিনি জুলাইয়ে ঠেললেন। দু’মাস আগেই রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন সেরে ফেলা যেত। কিন্তু তিনি কালক্ষেপ করলেন। কেন করলেন? কারণ, তিনি সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে ব্যর্থ। কালক্ষেপের কারণে বর্ষার মুখে দাঁড়িয়ে যখন পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে মানুষের মনে অনিশ্চয়তা তখন দুম করে পঞ্চায়েত ভোট ডেকে দিলেন তিনি। কেন ডাকলেন? কারণ, তিনি প্রতিপক্ষ সবাইকে অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে ফেলতে চান।

অথচ রাজনৈতিক শত্রুদের বিড়ম্বনায় ফেলার চাইতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল বাংলার ৬৩ হাজার ২৮৩টি গ্রামে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপুল বিজয় হয়েছিল শাসকদলের। কিন্তু তাতে সরকার ও প্রশাসনের সুনাম বাড়ে নি। কারণ, নির্বাচনকালে হিংসা ও সন্ত্রাস রোধে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল প্রশাসন। বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হয় নি। ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ভোটের দিন নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ‌ই পান নি নাগরিকেরা। রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়েছিল ১৮টি প্রাণ। ইতরামি করে জেতা যায়। কিন্তু মাথা উঁচু করে চলার সাহস থাকে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উঁচু মাথা নিচু করে দিয়েছিল আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটের সন্ত্রাস। পাঁচ বছর পরে কলঙ্ক মোচনের সুযোগ এসেছে। সুযোগের সদ্ব্যবহারে এত কুন্ঠিত কেন তিনি?

এবারেও মাত্র একদফায় ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ভোট হচ্ছে রাজ্যে। নবান্ন চেয়েছে তাই একদিনেই ভোট নিচ্ছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। বিরোধীরা কেন্দ্রীয় বাহিনী দাবি করলেও কেন্দ্রীয় বাহিনীর নামেই যেন এলার্জি রাজ্য সরকারের। অথচ রাজ্যের হাতে পর্যাপ্ত পুলিশ নেই। পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৬১ হাজার ৬৩৬টি। একটি ভোটকেন্দ্রে একাধিক বুথ থাকে। প্রতি ভোটকেন্দ্র পিছু মাত্র দু’জন করে সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হলেও পুলিশ দরকার ১ লক্ষ ২৩ হাজার ২৭২জন। শুধু তো ভোটকেন্দ্র পাহারা দিলেই চলবে না। নাকা তল্লাশি থেকে টহলদারি এবং অশান্তি মোকাবিলায় কুইক রেসপন্স টিম প্রস্তুত রাখতেও অনেক কর্মী দরকার। সব মিলিয়ে দেড় লক্ষ পুলিশের ব্যাপার। অথচ রাজ্যের হাতে পুলিশ আছে মাত্র ৭৮ হাজার। দুই-তিনদফায় ভোট করলে এক জেলার বাহিনী আরেক জেলায় পাঠিয়ে পরিস্থিতি সহজেই সামাল দেওয়া সম্ভব হত।

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বহু দফাতেও ভোট চান না। আবার কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতেও ইচ্ছুক নন। রাজনৈতিক বাতাবরণ সৌহার্দ্যপূর্ণ থাকলে সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি ছাড়াই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট সম্ভব। একটা সর্বদল বৈঠক ডেকে মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে বলতেই পারতেন, আমাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য যাই থাকুক, আসো আমরা হানাহানি বন্ধ করি; ভোটে সবাই মিলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখি। তিনি তো রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হ‌ওয়ার সূত্রে শাসক-বিরোধী সকলের অভিভাবক। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি একটা সর্বদল বৈঠক ডাকতে পারতেন না? কিন্তু ডাকেন নি। পছন্দ করেন না বলেই ডাকেন নি। তিনি বহু দফায় পঞ্চায়েত ভোট চান না। ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী চান না। সর্বদল বৈঠক চান না। নিরপেক্ষ ও দৃঢ়চেতা একজন নির্বাচন কমিশনার‌ও চান না। তবে চাইছেনটা কী? যে শাসক হীন দলীয় স্বার্থে সুশাসনকে ভয় পান, তাঁকে সৎ ও সাহসী শাসক বলে না।

Feature image is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *