একদা নিজেদের স্বার্থেই ভারতবর্ষে রেলপথ পেতেছিল ইংরেজ বণিক সম্প্রদায়। কিন্তু কালক্রমে রেলপথ ভারতের ‘লাইফ লাইন’ বা জীবনরেখায় পরিণত হয়। মোট আয়তনে ভারতীয় রেল ব্যবস্থা বিশ্বে চতুর্থ হলেও যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের ব্যাপকতা, দিবারাত্রি ২৪ ঘন্টার ব্যস্ততা, বহুত্ব এবং জনজীবনের উপর সার্বিক প্রভাবে এর তুল্য রেল ব্যবস্থা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। ভারতীয় রেল ভারতের মতোই বিরাট ও বৈচিত্র্যময়। এই জীবনরেখায় যখনই অকস্মাৎ কোনও বড় ধাক্কা আসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই গোটা ভারত বিচলিত হয়ে পড়ে। তেমনই একটি বড় আঘাত এসেছে শুক্রবার কালসন্ধ্যায় ওড়িশার বালেশ্বরের বাহানগা স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়। দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালগাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে আপ করমন্ডল এক্সপ্রেসের ১৭টি কামরা। সেই মুহূর্তেই ডাউন লাইনে ছুটছিল যশবন্তপুর থেকে হাওড়াগামী হামসফর এক্সপ্রেস। করমন্ডলের দুর্ঘটনাগ্রস্ত কয়েকটি কামরায় ধাক্কা মেরে লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে হামসফরের শেষের দিকের দুটি কোচও। ভয়াবহ এই ট্রেন দুর্ঘটনায় ৩০০ জন হতভাগ্য যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। ১৬০টি দেহ শনাক্তের অযোগ্য! এতেই বোঝা যায় সংঘর্ষের অভিঘাত কী মারাত্মক ছিল।
স্বাধীনতার আগে ও পরে ভারতের ‘লাইফ লাইনে’ এমন তীব্র আঘাতের ঘটনা নতুন নয়। চালকের অসতর্কতা, লাইনে ফাটল, সিগন্যালিং ব্যবস্থায় যান্ত্রিক ত্রুটি, রেলের অপারেটিং সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের কর্তব্যে গাফিলতি এমনকি নাশকতার জেরেও বড় বড় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে ভারতে। প্রযুক্তির উন্নতি ও পরিকাঠামোর আধুনিকীকরণ দ্বারা ট্রেন দুর্ঘটনার সংখ্যা কমিয়ে আনার পাশাপাশি এর ভয়াবহতা বহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ভারতীয় রেলের আধুনিকীকরণের কাজ বিশেষ এগোয় নি। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর রেলের আধুনিকীকরণে জোর দেন। প্রযুক্তি, পরিকাঠামো, পরিষেবা, পরিচ্ছন্নতা, গতি, যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য, এবং সৌন্দর্য- সবদিক দিয়েই ভারতীয় রেলের খোলনলচে বদলে দিতে চায় মোদী সরকার।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের রেল নীতি নিয়ে অনেক সমালোচনাও আছে। বিরোধীদের অভিযোগ, রেল ব্যবস্থার বাইরের চাকচিক্য বৃদ্ধিতে সরকার যতটা নজর দিচ্ছে, ততটা ভেতরের দুর্বলতা সারাতে নয়। তবে ট্রেনের সংখ্যা, ট্রেনের গতি এবং যাত্রী পরিষেবার মান যে অতীতের থেকে অনেক বেড়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যাত্রীরা গতি ও স্বাচ্ছন্দ্য তো চানই তবে সবার আগে চান নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে। সরকারও যে যাত্রী সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত নয়, এই অভিযোগ করা যাবে না। এখন রেলের ‘সিগন্যালিং’ ও ‘অপারেটিং সিস্টেমের’ পুরোটাই স্বয়ংক্রিয়। অত্যাধুনিক কোচগুলিও এমনভাবে তৈরি যে লাইনচ্যুত হলেও প্রাণঘাতী আঘাত থেকে যাত্রীদের রক্ষায় অনেকটাই সক্ষম। ট্রেনে ট্রেনে সংঘর্ষ রোধে এখন ‘অ্যান্টি কলিশন’ প্রযুক্তি বা রক্ষাকবচ ব্যবহার করা হচ্ছে। করমন্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর এই ‘কবচ’ পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। যদিও রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, করমন্ডল, হাওড়া-যশবন্তপুর হামসফর বা মালগাড়ি- কোনওটিতেই ব্যয়বহুল ‘কবচ’ পদ্ধতি ছিল না।
প্রাথমিক তদন্ত থেকে মনে করা হচ্ছে, সিগন্যালিং ব্যবস্থার কোনও গাফিলতির কারণে বালেশ্বরে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই গাফিলতি যন্ত্রের না মানুষের- তা এখনও জানা যায় নি। বাহানগা স্টেশনের লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল লৌহ আকরিক বোঝাই মালগাড়ি। মালগাড়িটি খড়্গপুর থেকে ছেড়ে এসেছিল। বাহানগা স্টেশনে করমন্ডল থামে না। মেন আপ লাইন দিয়ে ট্রেনটির দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। আপ লাইনের সিগন্যাল সবুজ থাকার পরেও করমন্ডলের চালক কেন ট্রেনটি লুপ লাইনে ঢুকিয়ে দিলেন, প্রশ্ন এখানেই। সিগন্যালিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত অন্য কোনও যান্ত্রিক বা মনুষ্য চালিত গাফিলতির জেরেই ঘন্টায় ১২৮ কিলোমিটার গতিতে চলা করমন্ডল এক্সপ্রেস লুপ লাইনে ঢুকে পড়ে বলে মনে করছেন রেলের বিশেষজ্ঞরা।
প্রত্যেকটা জীবনেরই অনেক স্বপ্ন থাকে। ভারতের জীবন রেখা রেল প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ জীবনের কত স্বপ্ন বহন করে। যে তিনশ যাত্রী গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই পথে নিষ্প্রাণ-নিথর হয়ে গেলেন, তাঁদেরও মনে না জানি কত স্বপ্ন ছিল। মৃতদের অধিকাংশই অসংরক্ষিত জেনারেল ক্লাসের যাত্রী। বেশিরভাগই কাজের উদ্দেশ্যে বা কর্মস্থলে যোগ দিতে বাংলা থেকে যাচ্ছিলেন। অনেক কষ্ট করে ‘জেনারেল ক্লাসে’ তাঁদের ভ্রমণ করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব আশ্বাস দিয়েছেন, দুর্ঘটনার কারণ জানতে যথাযথ তদন্ত হবে এবং কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাকে রেয়াত করা হবে না। জনগণ প্রত্যাশা করে, এই আশ্বাসবাক্য বৃথা যাবে না।
শুধু দোষীদের শনাক্ত ও শাস্তি দিয়েই সরকারের কাজ শেষ হবে না। এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে যাত্রী সুরক্ষার বিষয়ে আরও সতর্ক ও সাবধান হতে হবে রেল কর্তৃপক্ষকে। শুধু বন্দেভারত ও তেজসের মতো সেমি হাইস্পিড ট্রেন চালু করাই রেলের আধুনিকীকরণের জন্য যথেষ্ট নয়। বেছে বেছে প্রিমিয়াম ট্রেনের যত্ন নিলেও চলবে না। ভারতীয় রেলের বিশাল ও জটিল পরিকাঠামোর সার্বিক উন্নতিতে নজর দিতে হবে সরকারকে। দ্রুত গতিতে গন্তব্যে পৌঁছানো এবং যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য দরকার কিন্তু যাত্রাপথের সুরক্ষা সবার আগে। সুরক্ষার প্রশ্নে কোনও আপোষ বা কার্পণ্য নয়। একটি বড় দুর্ঘটনা কীভাবে রেলের যাবতীয় অর্জনকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়- করমন্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে এই শিক্ষা নিয়ে রেল মন্ত্রক ভবিষ্যত পরিকল্পনা তৈরি করবে বলে আশা করা যায়।