ইন্টারনেট এখন সুলভ এবং অত্যন্ত দ্রুত গতির। ফোর জি-র যুগ শেষ করে ফাইভ জি-তেও পৌঁছে গেছে অন্তর্জালের জগত। মোবাইলে মাত্র সাত ইঞ্চি স্ক্রিনের জানালা খুলে দিয়ে ঘরে বসে বিশ্বদর্শনও সম্ভব। বিনোদন, সামাজিক যোগাযোগ তো বটেই এমনকি পড়ালেখা, উচ্চশিক্ষা, কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, ছোটবড় আর্থিক লেনদেনও এখন ইন্টারনেট নির্ভর। জগতে যার গুণ আছে তার দোষও আছে। ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোনও প্রকৃতির এই ধর্মের ব্যতিক্রম নয়। মানুষের মোবাইল ফোন আসক্তি দেখে ঘাবড়ে গেছেন স্রষ্টা মার্টিন কুপারও।
মানুষ এখন স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে যতটা না কথা বলার জন্য তার চেয়ে বেশি সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় থাকার জন্য। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাটা তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু সামাজিক মাধ্যম যখন অসামাজিক কাজের জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে ওঠে তখন সমাজের স্বার্থেই আর চুপ করে থাকা যায় না। ব্যক্তি স্বাধীনতা আধুনিক যুগে মানব জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। সমাজের একজন হয়েই এই স্বাধীনতা আমরা উপভোগ করি। সমাজে স্বীয় স্বাধীনতা নিয়ে ভালভাবে বাস করার জন্য হিতাহিতের জ্ঞান থাকাটা খুব জরুরি। এই হিতাহিতের জ্ঞান, কান্ডজ্ঞান কি আমাদের মধ্যে থেকে দ্রুতই লোপ পাচ্ছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই এমন সব ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে, তাতে এই আশঙ্কা অমূলক নয়।
জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানানো প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। বোধ হওয়ার পরেই সন্তানকে কর্তব্যটি শিখিয়ে দেওয়া প্রত্যেক দায়িত্বশীল বাবা-মায়ের কর্তব্য। শিশুরা একটু বড় হলে তাদের দেশপ্রেমের পাঠ দেওয়ার জন্য স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা তো আছেনই। এমন একটি ভাইরাল ভিডিও লোকের মোবাইলে মোবাইলে ঘুরছে আর শেয়ার হচ্ছে, যা দেখে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- জাতি হিসেবে উচ্ছন্নে যেতে আমাদের আর কতটা পথ বাকি? দুই বঙ্গ ললনা, এখনও কৈশোর কাল উত্তীর্ণ হয় নি- তারা জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে ছ্যাবলামি করছে সিগারেট হাতে নিয়ে। তাদের বেশভূষা, অঙ্গভঙ্গি দেখলে যে কোনও সুস্থ রুচির মানুষের বিবমিষার উদ্রেক হবে। আড়ালে হোক আর প্রকাশ্যে, জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে অভদ্রতা-অভব্যতা করাটাই অপরাধ। যারা সেটা করে তাদের সম্পর্কে ‘বেজন্মা’ শব্দটি প্রয়োগে আমাদের অন্তত কোনও দ্বিধা নেই। মেয়ে দুটি জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা তো করেছেই,. ঘটনাটি ভিডিও করে তা নিঃসঙ্কোচে সামাজিক মাধ্যমেও শেয়ার করেছে।
ভিডিও ভাইরাল হতেই ছিঃ ছিক্কার পড়ে গেছে। অনেকেই মেয়ে দুটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়ে লালবাজার ‘সাইবার ক্রাইম প্রিভেনশন সেল’-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দু’জনেরই পরিচয় ও নিবাস জানা গেছে। এরা একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। জাতীয় সঙ্গীতকে যে সম্মান করতে হয়- একাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের সেই বোধ হয়ে যাওয়া উচিত। এরা বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের কিশোরী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে হাহা হিহি করে ভিডিও বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করে দেওয়ার আগে পর্যন্ত এদের চৈতন্য হল না। জানাজানি হওয়ার পর এখন পোস্ট মুছে দিয়ে বলছে- মজার ছলে কাজটা করে বসেছিল তারা! আইনে জাতীয় সঙ্গীত অবমাননা করার নির্দিষ্ট শাস্তি রয়েছে। নাবালিকা বলে জাতীয় সঙ্গীত অবমাননা করার ধারা হয়তো এদের উপর প্রয়োগ করবে না আদালত। যদিও জুভেনাইল কোর্টে মেয়ে দুটিকে তুলতে কোনও বাধা নেই। শাস্তির কথা তো পরে। সব থেকে বড় প্রশ্ন হল- মেয়ে দুটির এমন অধঃপতন হল কেমন করে এবং এর জন্য দায়ী কারা?
এর আগেও একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল- একটি স্কুল ছাত্র, ইউনিফর্ম পরে নেতাজির মূর্তিকে চপেটাঘাত করছে, গালিগালাজ করছে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় খিস্তি-খাস্তা, স্কুল ড্রেস পরে ক্লাসরুমে অশালীন অঙ্গভঙ্গি, কানে আঙুল দেওয়ার মতো কথাবার্তা বলে সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও আপলোড করতে হামেশাই দেখা যাচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের। যখন বিষয়টি জাতীয় সঙ্গীত-জাতীয় পতাকাকে অসম্মান বা নেতাজিকে অপমান করার জায়গায় চলে যায়, তখন নীরবতা ভঙ্গ না করে আর উপায় থাকে না আমাদের।
সম্প্রতি বাংলাদেশের নাট্যজগতের প্রখ্যাত শিল্পী মামুনুর রশিদ ঘটনা প্রসঙ্গে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ বলে একটি শব্দ প্রয়োগ করে সে দেশের সমাজে আলোড়ন তুলেছেন। রুচির দুর্ভিক্ষ ঘর-পরিবার পর্যন্ত সংক্রমিত না হলে একাদশ শ্রেণির দুই ছাত্রীর দ্বারা জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করে ভিডিও পোস্ট করার ঘটনা ঘটত না। বখে যাওয়ার জন্য বাচ্চারা নয়, দায়ী আমরা বড়রাই।
Feature Image is Representational.