চিনের কমিউনিস্ট পার্টিতে যৌথ নেতৃত্বের কার্যত অবসান। দলের সর্বোচ্চ স্তরে বিরুদ্ধবাদীদের নির্মূল করে শি জিনপিং এখন একনায়কের আসনে। মাওয়ের পর শিকেই বলা হচ্ছে চিনের সবথেকে শক্তিশালী নেতা।
পলিটিক্যাল ডেস্ক: মাও দেজং-এর পর তাঁকেই বলা হচ্ছে কমিউনিস্ট চিনের সবথেকে শক্তিশালী নেতা। তৃতীয় বারের জন্য চিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন শি জিনপিং। চিনের পার্লামেন্ট ‘ন্যাশনাল পিপল’স কংগ্রেস’ জিনপিংকে তৃতীয়বারের জন্য দেশের সর্বোচ্চ পদে নির্বাচিত করেছে। দ্বিতীয় কোনও প্রার্থী না থাকায় শি’র নির্বাচন সর্ব সম্মতিক্রমে হয়েছে বলে শুক্রবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি। আগামী আরও পাঁচ বছর চিনকে নেতৃত্ব দেবেন ৭০ বছরের শি জিনপিং।
২০১৩-র ১৪ মার্চ চিনের প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেন শি। তার আগেই অবশ্য চিনের কমিউনিস্ট পার্টিতে জিনপিং যুগের সূচনা হয়ে যায়। চিনের একদলীয় রাজনীতিতে টানা দশ বছর পার্টি ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থাকা যেমন তেমন ব্যাপার নয়। এবার কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ স্তরে নিজের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রেখে আরও একদফা নিজের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন শি জিনপিং। অর্থাৎ মাঝে কোনও বড় বিপত্তি না ঘটলে টানা পনেরো বছর চিনের কমিউনিস্ট পার্টি ও চিন রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেবেন শি। একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনে শি প্রায় একনায়কেই পরিণত হয়েছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। গত অক্টোবরেই চিনা কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে দলের সাধারণসম্পাদক পদে তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচিত হন জিনপিং। তখনই আন্তর্জাতিক মহল ধরে নিয়েছিল, চিনের রাষ্ট্রপতি পদে শি-র প্রত্যাবর্তন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
শি জিনপিং একাধারে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ পদাধিকারী এবং চিন সরকারের সর্বোচ্চ প্রধান, সেই সূত্রে তিনি চিনের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কও। শি নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবথেকে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। চিনের কমিউনিস্ট পার্টিতে যাঁরা শি বিরোধী, এই দশ বছরে পার্টির ভেতরে তাঁদের ধীরে ধীরে কোনঠাসা করে ফেলেছেন শি জিনপিং। অক্টোবরে অনুষ্ঠিত পার্টি কংগ্রেসে বিরোধীদের অবস্থা আরও শোচনীয় করে তোলেন শি। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এখন কার্যত জিনপিং-এর দখলে। কেন্দ্রীয় কমিটির সব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের অনুগামীদের বসাতে সমর্থ হয়েছেন তিনি। এই জন্যই শি জিনপিংকে বলা হচ্ছে মাও-এর পরে চিনের সবথেকে শক্তিশালী নেতা। চিনের কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। নেতৃত্ব নিয়ে দলের অভ্যন্তরে এই দ্বন্দ্বকে কমিউনিস্ট পার্টিতে বলা হয়ে থাকে আন্ত:পার্টি সংগ্রাম। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে মাও দেজং পার্টিতে শত্রু নিধন করে নিজের কর্তৃত্ব নিষ্কন্টক করেছিলেন। জীবদ্দশায় লাল চিনের রূপকার মাও হয়ে উঠেছিলেন একনায়ক।
মাও বেঁচে থাকতে পার্টির মধ্যে কেউই তাঁকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে নি। তবে মাও যাঁদের পার্টির ভেতরে কোনঠাসা করে রেখেছিলেন মাওয়ের মৃত্যুর পর তাঁরাই গৃহযুদ্ধ তুল্য পরিস্থিতিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের দখল নেন। মাও বিরোধী নেতাদের মধ্যে দেং জিয়াও পিং ছিলেন অন্যতম। দেং জিয়াও পিং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নিগৃহীতও হয়েছিলেন। মাওয়ের পর চিনে দেং জামানার সূত্রপাত হয়। এবং দেং জিয়াও পিং-এর হাত ধরেই চিন অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের রাস্তা নেয়। মাও পরবর্তী চিনে দেং জিয়াও পিং নিঃসন্দেহে বিরাট নেতা ছিলেন কিন্তু চিনা কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে দেংও নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করতে পারেন নি, যেমনটা পেরেছেন শি জিনপিং। চিনের ভেতরে ঠিক কী চলছে, বাইরে থেকে তা আন্দাজ করা শক্ত। তবে যে পশ্চিমী রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও কূটনীতিকরা চিনের রাজনীতির উপর নজরদারি চালান, তাঁরা মনে করছেন- কমিউনিস্ট পার্টি ও প্রশাসনের ভেতরে যৌথ নেতৃত্বের ব্যবস্থাকে প্রায় শেষ করে এনেছেন শি। চিনের রাজনীতিতে পার্টি ও প্রশাসন একাকার। পার্টিই সরকার ও প্রশাসনকে চালনা করে। পার্টির পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে এখন এমন কেউই নেই, যিনি শি জিনপিং-এর সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। অর্থাৎ পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে নিজের বিরোধী সকলকেই সরিয়ে দিয়েছেন শি। শির হাত ধরে চিন একক নেতৃত্বের যুগে প্রবেশ করেছে বলা চলে।
শি জিনপিং যতটা না কমিউনিস্ট তার চেয়ে অনেক বেশি জাতীয়তাবাদী। শি সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চিনকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। শির চিন প্রতিবেশীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যের নীতিতে বিশ্বাসী নয়। তাইওয়ানকে লুপ্ত করে দিয়ে চিনের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার প্রশ্নে পূর্বতন যে কোনও চিনা রাষ্ট্রনায়কের তুলনায় শি জিনপিং অনেক বেশি আগ্রাসী। শির জামানাতেই ভারতের সঙ্গে চিনের সীমান্ত বিরোধ গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সবথেকে তিক্ত জায়গায় পৌঁছেছে। চিনকে সুপার পাওয়ার করাই শি জিনপিং-এর স্বপ্ন। চিন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে একঘরে করতে চায়। পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার মিত্র জাপানকে ত্রস্ত রাখতে চায়। ঋণের জাল বিস্তার করে আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলিকে অধীনস্থ করতে আগ্রহী। গত দশ বছরে শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে চিনের অর্থনৈতিক উন্নতি নিঃসন্দেহে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ গবেষণাতেও চিন চমকপ্রদ সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু কোভিড অতিমারির ধাক্কায় চিনের অগ্রগতি শ্লথ হয়ে পড়ার যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। করোনা শুধু শির চিনকে ভেতরেই বিপন্ন করে নি আন্তর্জাতিক মহলেও চিনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
শি জিনপিং-এর চিনের বিরুদ্ধে আমেরিকা সহ পশ্চিমী দুনিয়ার সবথেকে বড় অভিযোগ- অশুভ উদ্দেশ্যে কোভিড-নাইন্টিন ভাইরাস উহানের ল্যাবরেটরিতে তৈরি করেছে চিন। করোনা ভাইরাস চিন থেকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। চিন কোভিড-নাইন্টিন ভাইরাস নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিদের পর্যাপ্ত তথ্য দেয় নি বলেও অভিযোগ। কৃত্রিম ভাবে করোনা ভাইরাস তৈরির অভিযোগ বেজিং দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করলেও এখনও চিনের উপর থেকে সন্দেহ দূর হয় নি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।
দলের ভেতর ও বাইরে বিরুদ্ধ মতের মোকাবিলায় শি জিনপিং-এর প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতিতেই বিশ্বাসী। শির চিনে গণতন্ত্র দূরের কথা মত প্রকাশের সীমিত স্বাধীনতা পর্যন্ত খর্বিত। চিনের রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করেছেন শি জিনপিং। যে কোনও ধরণের বিক্ষোভ দমনে সরকার নির্দয়। কোভিডে চিনে ঠিক কত লোকের মৃত্যু হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকার চেপে গেছে বলেই আন্তর্জাতিক মহলের আশঙ্কা। শি জিনপিং এক সময় ‘জিরো কোভিড’ নীতি কার্যকর করতে উঠেপড়ে লাগেন। দেশ জুড়ে জারি করা হয় কঠোর লকডাউন। লকডাউনের কারণে নাগরিকদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। প্রতিবাদে রাজধানী বেজিং সহ চিনের একাধিক শহরে জনবিক্ষোভ চরমে ওঠে। নাগরিকদের বিক্ষোভ যদিও কঠোর হাতে দমন করতে দেরি করে নি জিনপিং-এর সরকার। আপাতত শি জিনপিং সমস্ত বিপদ কাটিয়ে উঠেছেন বলেই মনে করছেন চিন বিশেষজ্ঞরা। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকারে শির আধিপত্য এখন নিরঙ্কুশ।
Feature Image is representational. Photo Credit- AFP.