বিশেষ প্রতিবেদন: অনেক চেষ্টা করেও তিহাড় জেলের ডাল-রোটি খাওয়া থেকে রেহাই পেলেন না গরু পাচারে অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডল। যে’দিন কেষ্টকে নিয়ে ইডির আধিকারিকেরা কলকাতা বিমানবন্দর থেকে দিল্লির ফ্লাইট ধরলেন, সে’দিনই কেষ্টর শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাই ধরে নিয়েছিলেন, এ যাত্রা আর তিহাড় জেলের হাওয়া না খেয়ে তার ঘরে ফেরা সম্ভব হচ্ছে না। তিহাড় জেল নিয়ে সবারই খুব কৌতুহল। আপাতত ৩ এপ্রিল পর্যন্ত যে তিহাড় জেল বীরভূম তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডলের ঠিকানা, সেই তিহাড় জেল নিয়ে কিছু তথ্য জানা যাক-
তিহাড় জেলকে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সবথেকে বড় কারাগার বা বন্দিশালা। দেশ স্বাধীন হওয়ার ১০ বছর পরে ১৯৫৭ সালে রাজধানী দিল্লির জনকপুরীতে মাত্র ১২৭৩ জন বন্দি নিয়ে তিহাড় জেল চালু করা হয়। পশ্চিম দিল্লির তিহাড় গ্রামের তিন কিলোমিটারের মধ্যে এর অবস্থান। তিহাড় গ্রামের নামেই জেলের নাম রাখা হয় তিহাড় জেল। ১৯৬৬ পর্যন্ত তিহাড় জেলের ব্যবস্থাপনা ছিল পাঞ্জাব সরকারের কারা দফতরের হাতে। এরপর জেলটির দায়িত্ব নেয় ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি অব দিল্লির অধীনস্থ কারা দফতর। বর্তমানে দিল্লি সরকারের কারা বিভাগ তিহার জেলের দায়িত্বে।
৪০০ একর জমির ওপর নয়টি পৃথক পৃথক কেন্দ্রীয় কারাগার নিয়ে তিহাড় জেল তৈরি। তিহাড় জেলকে এ’জন্য জেল না বলে অনেকগুলি জেলের একটি কমপ্লেক্স বা প্রিজন কমপ্লেক্স বলা হয়ে থাকে। তিহাড় জেলের বন্দি ধারণ ক্ষমতা ১০,০২৬। যদিও তিহাড়ে সবসময়ই ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন বন্দি থাকে। ২০১৯-এর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পেশ করা একটি হিসেব থেকে জানা যাচ্ছে, তিহাড় জেলে বন্দির সংখ্যা ১৭ হাজার ৫৩৪ জন।
তিহাড় জেলের সঙ্গে নাম জড়িয়ে আছে দেশের বিখ্যাত আইপিএস অফিসার কিরণ বেদীর। ১৯৯৩ সালে কিরণ বেদী দিল্লির আইজি ( প্রিজন)-এর দায়িত্ব নিয়ে তিহাড় জেলের ভোল পাল্টে দেন। তিহাড় জেলের নাম পাল্টে তিহাড় আশ্রম করেন কিরণ। জেলের অভ্যন্তরে একাধিক সংস্কার করেন। কারাগার হয়ে ওঠে সংশোধনাগার। বন্দি ও জেলের কর্মীদের নিয়ে বিপাসনা ধ্যান চালু করেন তিনি। বন্দিদের লেখাপড়ার সুব্যবস্থাও চালু হয় কিরণ বেদীর হাত ধরে। তিহাড় জেলে উল্লেখযোগ্য সংস্কার সাধনের জন্য ১৯৯৪ সালে রামন ম্যাগসাসেয় পুরস্কার পান কিরণ বেদী।
তিহাড় জেলের ভেতরে একটি এফএম রেডিও স্টেশন আছে, যা চালান জেলের কয়েদিরাই। তিহাড় জেল কমপ্লেক্সের ভেতরে প্রথম কারখানা চালু করা হয় ১৯৬১ সালে। এখন সেখানে বেকারি, জামাকাপড়, রাসায়নিক দ্রব্যাদি, কাগজ, হস্তশিল্প এবং জুতা সহ বিভিন্ন সামগ্রী প্রস্তুত হয়। প্রতিদিন ৭০০ কয়েদি এই জেল ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। তিহাড় জেলে তৈরি সামগ্রীর নিজস্ব ‘ব্র্যান্ড নেম’ও রয়েছে বাজারে।
দূর শিক্ষণের মাধ্যমে তিহাড় জেলের ভেতরে বন্দিদের উচ্চশিক্ষা লাভ ও পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। তিহাড় থেকে এক বন্দী ইউপিএসসি পরিচালিত সিভিল পরীক্ষাতেও সফল হয়েছেন। এখন বহু বন্দিই তিহাড় জেলে থেকেই উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করেছেন। ২০১১ থেকে তিহাড় জেলে ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টেরও ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ভাল ব্যবহার, দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে ২০১৪ সালে তিহাড় জেল থেকে ৬৬জন বন্দিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া হয়। কেউ কেউ মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরিও পেয়ে যায়।
তিহাড় জেলের খানা
তিহাড় জেলে সকাল সাতটার মধ্যে কয়েদিদের প্রাতরাশ দেওয়া হয়। প্রাতরাশে থাকে চা, পোহা অথবা কুলচে ছোলে। দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যে মধ্যাহ্নভোজন সেরে ফেলতে হয় বন্দিদের। দুপুরে থাকে চারটা রুটি, ভাত, সবজি এবং ডাল। বিকেলের টিফিনে চা-বিস্কিট। নৈশাহারের সঙ্গে মেনু দুপুরের মতোই।
প্রত্যেক রবিবার এবং দিওয়ালি, দশেরা, স্বাধীনতা ও প্রজাতন্ত্র দিবসের মতো উৎসবে স্পেশাল মেনু হয়ে থাকে। রবিবার ও বিশেষ বিশেষ দিনে পনীর, রাজমা, স্পেশাল সবজি, পাওভাজি, পুরি, ছোলা-ভাটুরে, ক্ষির, ভেজ পোলাও, দই ও মিষ্টি হয়ে থাকে। বন্দিরা জেলের ক্যান্টিন থেকেও বিভিন্ন ধরণের বেকারি আইটেম কিনে খেতে পারে। তিহাড় জেলে আমিষ রান্নার তেমন চল নেই। অনুব্রত মণ্ডলকে ভাত-ডাল-সব্জি খেয়েই কাটাতে হবে।
তিহাড় জেলে মৃত্যু দন্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের ফাঁসির ব্যবস্থাও আছে। এখনও পর্যন্ত তিহাড়ে ২০ জন সাজাপ্রাপ্তর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে-
- ১৯৫৮ সালের ৭ অগাস্ট তিহাড় জেলে প্রথমবারের মতো বচন সিং নামে এক কয়েদির ফাঁসি হয়।
- কুখ্যাত রঙ্গা ও বিল্লার ফাঁসি হয়েছিল তিহাড় জেলেই, ১৯৮২ সালের ১লা জানুয়ারি ভোরে।
- কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও জেকেএলএফ-এর প্রধান মকবুল ভাটের ফাঁসি হয়েছিল তিহাড়ে ১৯৮৪-র ১১ ফেব্রুয়ারি।
- তিহাড় জেলে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর খুনি দুই দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিং ও কেহর সিংয়ের ফাঁসির নির্দেশ কার্যকর হয়েছিল ১৯৮৯-এর ৬ জানুয়ারি শেষ রাতে।
- সংসদে জঙ্গি হামলার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণিত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদন্ডের সাজা হয়েছিল আফজল গুরুর। ৪৩ বছরের আফজল গুরুর ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল তিহাড় জেলে ২০১৩-র ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে।
- তিহাড়ে এখনও পর্যন্ত শেষ ফাঁসি হয়েছে ২০২০-এর ২০ মার্চ ভোরে। নিভর্য়া ধর্ষণ মামলায় মৃত্যুদন্ডের সাজাপ্রাপ্ত চার কয়েদি মুকেশ সিং, পবন গুপ্তা, বিনয় শর্মা ও অক্ষয়কুমার সিংয়ের ফাঁসি হয়।এটাই প্রথম তিহাড়ে একসঙ্গে চারজনের ফাঁসির ঘটনা। হাই সিকিউরিটি তিহাড় জেলে এখন ১০জন মৃত্যুদন্ডের সাজাপ্রাপ্ত আসামি আছে।
সাধারণ চোর-ছ্যাচড় থেকে বিলিয়নিয়ার শিল্পপতি। দাগি অপরাধি থেকে অভিযুক্ত আমলা। খুন-ধর্ষণের আসামি থেকে বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা- সবাইকেই ঠাঁই দেয় তিহাড় জেল-
- ছাত্রাবস্থায় জেএনইউ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে তিহাড় জেলে কাটিয়েছিলেন নোবেল স্মারক পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
- জনতা পার্টির আমলে তিহাড় জেলে ঢোকানো হয়েছিল ইন্দিরার পুত্র সঞ্জয় গান্ধীকেও।
- চার্লস শোভরাজের মতো কুখ্যাত আন্তর্জাতিক অপরাধী তিহাড় জেলে বন্দী ছিল। মুম্বাইয়ের আন্ডার ওয়ার্ল্ড ডন ছোটা রাজন এখন তিহাড়ে কয়েদ খাটছে।
- সাহারা গোষ্ঠীর অধিপতি সুব্রত রায় আর্থিক অনিয়মে অভিযুক্ত হয়ে তিহাড় জেলে বন্দি ছিলেন। বন্দি ছিলেন প্রয়াত শিল্পপতি ও সমাজবাদী পার্টির নেতা অমর সিংও।
- ইউপিএ জামানায় জন লোকপাল ও দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেফতার হওয়ার পর তিহাড় জেলে ছিলেন সমাজকর্মী আন্না হাজারে ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও।
- পশুখাদ্য মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবও তিহাড় জেলে কাটিয়েছেন। আইএনএক্স মিডিয়া স্ক্যামে অভিযুক্ত হয়ে সিবিআই-এর হাতে গ্রেফতারের পর তিহাড়ে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমও।
- লিকার স্ক্যামে অভিযুক্ত দিল্লির প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী ও আপ নেতা মণীশ শিসোদিয়াও বর্তমানে তিহাড় জেলে বন্দি আছেন।
তিহাড়ের পহেলবান সুপার
তিহাড় জেল ভারতের হাই সিকিউরিটি জেলগুলির মধ্যে অন্যতম। নিরাপত্তারক্ষী সহ মোট ২,৩০০ কর্মী তিহাড় জেলে মোতায়েন আছেন। গোটা জেল চত্বর সিসি ক্যামেরা দিয়ে মোড়া। বসানো আছে মোবাইল জ্যামার। তল্লাশিতে ব্যবহার করা হয় এক্সরে স্ক্যানার, মেটাল ডিটেক্টর।
তিহাড় জেলের বর্তমান সুপারের নাম দীপক শর্মা। পুরস্কার প্রাপ্ত বডি বিল্ডার আইপিএস অফিসার দীপক শর্মার বুকের ছাতি ৪৮ ইঞ্চি। বাইসেপ ১৯ ইঞ্চি। ওজন ৯০ কিলো। জেল পরিচালনা ও কয়েদিদের দেখভাল করার পাশাপাশি দিনে ৪-৫ ঘন্টা শরীরচর্চা করেন দীপক। অনুব্রত মণ্ডলকে এখন এই পহেলবান সুপারের নজরদারিতেই থাকতে হচ্ছে।
Feature Image is Representational.