৬৮ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারের সাগরদিঘিতে বিজেপি যে ভোট হারিয়েছে, তা ধরে রাখলেও উপনির্বাচনে কংগ্রেসের জয় অধরা থাকত না। তৃণমূল থেকে ১৬ শতাংশ ভোট যে কংগ্রেসে গেছে, ভোটের পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট। একটি ভোট পরবর্তী বিশ্লেষণ-
সাগরদিঘি উপনির্বাচনে গো হারা হারের পর তৃণমূল শিবির বাইরে যতই রাম-বাম-কং তত্ত্ব নিয়ে সরব থাকুক না কেন ভেতরে ভেতরে যে ভয় ধরেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ভয় সংখ্যালঘু ভোট হারানোর। যে সংখ্যালঘু ভোটের হাত ধরে একুশে তৃণমূলের চমকপ্রদ কামব্যাক,সেই ভোট মমতার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে না তো? খোদ তৃণমূল সুপ্রিমো বিষয়টি নিয়ে ভীষণ চিন্তায় বলে জানা যাচ্ছে। আসলে সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বিজেপির ভোট কংগ্রেস-বাম প্রার্থীকে জিতিয়ে দিয়েছে- ফল বিশ্লেষণের পর এই কথা বলারই মুখ নেই তৃণমূলের।
সাগরদিঘিতে গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় ভোটদানের হার কমেছে সামান্যই। অথচ মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে সাগরদিঘিতে শাসকদলের ভোট কমেছে ১৬.১ শতাংশ। বিজেপিরও ভোট কমেছে কিন্তু তৃণমূলের তুলনায় কম। উপনির্বাচনে বিজেপির ভোট কমেছে ১০.১৪ শতাংশ। সাগরদিঘি উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন বিশ্বাস তৃণমূলের দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়েছেন ২২ হাজার ৯৮৬ ভোটের ব্যবধানে। সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফল থেকে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার- বিজেপি যদি একুশের নির্বাচনে পাওয়া ভোট উপনির্বাচনে ধরেও রাখত, তারপরেও তৃণমূলের পরাজয় আটকাতো না। আর এই বিষয়টাই তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছে।
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী প্রয়াত সুব্রত সাহা পেয়েছিলেন ৯৫ হাজার ১৮৯ ভোট। যা প্রদত্ত ভোটের ৫০.৯৫ শতাংশ। বিজেপির মাফুজা খাতুন পেয়েছিলেন ৪৪ হাজার ৯৮৩ ভোট। যা প্রদত্ত ভোটের ২৪.০৮ শতাংশ। কংগ্রেসের এসকে এম হাসানুজ্জামান পেয়েছিলেন ৩৬ হাজার ৩৪৪ ভোট। যা প্রদত্ত ভোটের ১৯.৪৫ শতাংশ। উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছেন ৬৪ হাজার ৬৮১ ভোট। তৃণমূলের ভোট কমেছে ৩০ হাজার ৫০৮টি। কংগ্রেসের বায়রন বিশ্বাস পেয়েছেন ৮৭ হাজার ৬৬৭ ভোট। কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ৫১ হাজার ৩০৩টি। উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী দিলীপ সাহা পেয়েছেন ২৫ হাজার ৮১৫ ভোট। বিজেপির ভোট কমেছে ১৯ হাজার ১৬৮টি। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেল এই ১৯ হাজার ১৬৮টি ভোটের সবকটিই গেছে কংগ্রেসের ঘরে। যদি এই ভোট বিজেপি ধরেও রাখত, তাহলে কংগ্রেসের ভোট কমে দাঁড়াত ৬৮ হাজার ৪৯৯টি। তাতেও কি বায়রনের জয় আটকে থাকত? তারপরেও তৃণমূলের থেকে ৩,৮১৮ ভোট বেশি পেয়ে কংগ্রেস সাগরদিঘি উপনির্বাচনে জিতে যেত।
৬৮ শতাংশ সংখ্যালঘুর বিধানসভা সাগরদিঘিতে তৃণমূলের ভোট ৫০.৯৫ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৩৪.৯৪ শতাংশ। ১৬.০১ শতাংশ ভোট হারিয়েছে শাসকদল। তারপরেও কোন মুখে কুণাল ঘোষরা দলের হারের পেছনে শুধুই বাম-বিজেপি-কংগ্রেসের অশুভ আঁতাত দেখতে পাচ্ছেন? সাগরদিঘিতে কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ২৭.৯ শতাংশ। তৃণমূল ও বিজেপি মিলে কমেছে মোট ১৬.০১+১০.১৪= ২৬.১৫ শতাংশ। যদি বিজেপির ভোট বিজেপিরই থাকত, তারপরেও কংগ্রেসের ভোট বাড়ত ১৬.০১ শতাংশ। যে ১৬.০১ শতাংশ ভোট তৃণমূলের ক্ষয় হয়েছে, তা যে কংগ্রেসের জয়ের কারণ হয়েছে, অংক থেকেই তা জলের মতো পরিষ্কার।
রাজ্যের সংখ্যালঘুরা তৃণমূল থেকে মুখ ফেরাচ্ছে, তা প্রথম টের পাওয়া গিয়েছিল বালিগঞ্জ উপনির্বাচন থেকে। বালিগঞ্জ উপনির্বাচনে বাবুল সুপ্রিয়র জয় হলেও তৃণমূলের ভোট শতাংশ কমেছিল। বালিগঞ্জ উপনির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল যথেষ্টই কম। কাজেই সংখ্যালঘুরা সত্যিই শাসকদল থেকে মুখ ফেরাচ্ছে কিনা তা নিয়ে একটা ধোঁয়াশা ছিলই। কিন্তু সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফল নিয়ে ধোঁয়াশার কোনও জায়গা আছে বলে মনে হয় না। ধোঁয়াশার জায়গা যে সত্যিই নেই, তা ভালই বুঝতে পেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার বিধানসভায় দলের পাঁচ সংখ্যালঘু নেতাকে নিজের ঘরে ডেকে একান্তে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। কীভাবে সংখ্যালঘুদের আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়, তা খুঁজে বের করতে ওই নেতাদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক তৃণমূলের ‘প্রাণ ভোমরা’। সেই ভোটে ধস নামলে যে ভবিষ্যতে তৃণমূলের বড় বিপর্যয় এড়ানো মুশকিল হবে তা রাজ্যের শাসক ও বিরোধী দুই শিবিরেরই ভাল করে জানা।