নেতানেত্রীদের মুখে আকথা-কুকথায় লাগাম পড়বে- আমরা নাগরিকদের সেই আশা এবার ত্যাগ করাই ভাল। যখন আপনি দেখেন রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ পদাধিকারীই বাক্যে বেলাগাম, তখন আপনি কীভাবে আশা করতে পারেন নিচু তলার নেতারাও বাক্যে শুচিতা রক্ষা করবেন? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সরকার ও রাজ্য প্রশাসনের প্রধান। গোটা রাজ্যের অভিভাবক। তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে যে ভাষা প্রয়োগ করলেন তা কি শোভন, রুচিসম্মত?
রাজ্য সরকারের কর্মচারী। এই সরকারি কর্মচারীদের সর্বোচ্চ অধিনায়ক মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বেই এই কর্মচারীরা তাঁদের উপরে ন্যস্ত যাবতীয় কৃত্য সম্পন্ন করে থাকেন। তার বিনিময়ে মাসের এক তারিখে তাঁরা বেতন পান। এই সরকারি কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে একটা আন্দোলন-অবস্থান করছেন। তাঁদের যে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করার অধিকার আছে, উচ্চ আদালতও তা মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ এই সরকারি কর্মচারীরা সাংবিধানিক গন্ডির মধ্যেই আছেন, কোনও ভাবেই তা লংঘন করেন নি। এখন তাঁদের দাবি পরিস্থিতি সাপেক্ষে সম্পূর্ণ ন্যায্য হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। রাজ্য সরকারের পক্ষে কর্মচারীদের সমস্ত দাবি মেনে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি এই মুহূর্তে নাও থাকতে পারে। কিন্তু আন্দোলনরত এই সরকারি কর্মচারীরা কি চোর-ডাকাত?
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ভরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁরই কর্মচারীদের বলছেন চোর-ডাকাত! রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। চোর-ডাকাতদের হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষা করাই যাঁর রাজধর্ম, তিনি যখন জেনেই গেছেন ডিএ-র দাবিতে অবস্থানে বসা সরকারি কর্মীরা চোর-ডাকাত, তাহলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? তাদের পুলিশে দিচ্ছেন না কেন? তাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ধারায় মামলা দায়ের করতে পুলিশকে নির্দেশ দিচ্ছেন না কেন?
মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, ডিএ-র দাবিতে বসে থাকা সরকারি কর্মচারীরা সব চিরকুটে চাকরি পেয়েছে। অর্থাৎ অসদুপায়ে, অন্যায্য পথে চাকরি পেয়েছেন তারা। মুখ্যমন্ত্রীর হাতে যদি যথেষ্ট প্রমাণই থাকে যে এরা সব বেআইনিভাবে চাকরি পেয়েছে, তবে তিনি এদের চাকরিচ্যুত করতে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ করছেন না কেন? রাষ্ট্র বা রাজ্যের যিনি প্রধান হন, তাঁর কর্তব্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। এবং এই কর্তব্য সংবিধান তাঁর উপরে ন্যস্ত করেছে। শপথবাক্য পাঠ করার সময় প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীদের সেই বাক্য উচ্চারণ করতে হয়। কাজেই আমি জানি এই সরকারি কর্মচারীরা অন্যায়ভাবে চাকরি পেয়েছে, কিন্তু আমি তাদের চাকরি খাবো না- এই কথাও একজন মুখ্যমন্ত্রী বলতে পারেন না।
রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইক হেঁকে বলছেন- “যে চোর-ডাকাতগুলো চিরকুটে চাকরি পেয়েছিল, সব গিয়ে বসে আছে ওই ডিএ-র ওখানে।” প্রথম কথা হচ্ছে এই ভাষা, এই শব্দ চয়ন অত্যন্ত অশোভন ও আপত্তিকর। শহিদ মিনারের নিচে অবস্থানে বসে থাকা সবাইকেই পাইকারি হারে চোর-ডাকাত বলে দাগিয়ে দিলেন রাজ্যের অভিভাবক। এ’ভাবে তিনি পারেন? ধরেই নিলাম মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় চিরকুটে চাকরি পাওয়া ‘চোরডাকাতদের’ অনেকেই সেখানে বসে আছে। কিন্তু আন্দোলনে সামিল সকলেই চোর-ডাকাত, এই তথ্যটা মুখ্যমন্ত্রী কোথা থেকে পেলেন? ডিএ-র দাবিতে আন্দোলনে অবতীর্ণ কর্মচারীদের মধ্যে একজনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে নিজের যোগ্যতায় চাকরি পান নি, কীভাবে মুখ্যমন্ত্রী তা শতভাগ নিশ্চিত হলেন?
অনুমানের বশে, বিদ্বেষ তাড়িত হয়ে প্রতিশোধ স্পৃহায় কিংবা ক্ষোভের জ্বালায় কারও বিরুদ্ধে কটূ মন্তব্য করা প্রশাসনিক প্রধানদের মুখে সাজে না। তা রাজধর্মোচিত নয়। গুরুদেব লিখেছিলেন- “রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান।” নাগরিকদের মান রাখা রাষ্ট্রের প্রধানের কর্তব্য। এটা খুব স্পষ্ট, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় সরকারি কর্মচারীদের মানহানি হয়েছে। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, আপনি যদি নাগরিকদের মান রাখতে না পারেন, বৃহৎ নাগরিকমন্ডলীও আপনার মান রক্ষায় যত্নশীল থাকতে পারবে না। জনগণমনের অধিনায়কত্বের গুরু দায়িত্ব যাঁর স্কন্ধে, তাঁর বাক্য ও কর্মে সবার নজর থাকে এবং তা সবাইকে প্রভাবিত করে।
Feature Image is representational.