রাণী রাসমণিকে উপেক্ষা করে বাঙালির নবজাগরণের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয় - nagariknewz.com

রাণী রাসমণিকে উপেক্ষা করে বাঙালির নবজাগরণের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়


কৈবর্ত রাণী সব বাধা উপেক্ষা করে কালী মন্দির বানিয়েছেন। প্রজাদের আর্তনাদে সাড়া দিয়ে নীলকর ঠ্যাঙাতে লেঠেল পাঠিয়েছেন। ইংরেজের বিরুদ্ধে মামলা জিতেছেন। কোম্পানির অত্যাচার থেকে জেলেদের রক্ষা করেছেন গঙ্গা লিজ নিয়ে। রাণী রাসমণিকে বাদ দিয়ে কেন উনিশ শতকে বাঙালির নবজাগরণের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়, ব্যাখ্যা করলেন ডঃ তমাল দাশগুপ্ত-

জানবাজারের রাণী রাসমণির কাহিনী এটা, যদিও এ কাহিনী শুরু হয় হালিশহরে। ভাষাতাত্ত্বিকরা একমত, হাবেলিশহর থেকেই নামটা এসেছে। যেমন জানবাজার। জন কোম্পানির নামে, নাকি কোনও জান মহম্মদের নামে, এই নিয়েই যত তর্ক। কিন্তু দাঁড়ান, জ্ঞান থেকেও তো জান হয়, অতীশ দীপঙ্করশ্রী যেমন জ্ঞান ছিলেন। যদিও আমরা ভুল করে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ডাকি। জ্ঞান ছিল উপাধি। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটাই হত জ্ঞানডাকিনী। এই জ্ঞান থেকে জান, জ্ঞানগুরু থেকে জানগুরু। তো কলকাতার কেন্দ্রস্থলে এই অঞ্চলে ধর্মঠাকুরের পীঠস্থান ছিল, সেই থেকে ধর্মতলা। এখানে চৌরঙ্গীনাথের আশ্রম ছিল। এখানে জন কোম্পানি আর জান মহম্মদের থেকে জানগুরুর দাবি কোনও অংশে কম? বুড়াশিবের নামে বুড়াবাজার যদি হয়, তাহলে জানগুরুর নামে জানবাজার হবে না কেন? কিন্তু সে যাক। জানবাজারের রাণী রাসমণির কথা বলব আজ।

হালিশহরে কোনা নামে একটা গ্রাম, সেখানে হারু ঘরামি নামেই হালিক কৈবর্ত হরেকৃষ্ণ দাস বেশি পরিচিত, কারণ তিনি খুব সুন্দর ঘর তৈরি করতে পারতেন। তাঁর স্ত্রীর নাম রামপ্রিয়া। রাণী রাসমণি এঁদের দুজনের সন্তান। ১৭৯৩ সালে, ১২০০ বঙ্গাব্দে তাঁর জন্ম। মঙ্গলে উষা বুধে পা, এমন সময় তাঁর জন্ম হয়েছিল, বুধবার ভোরে। কোনওদিন বাঙালি নারীর ইতিহাস লেখা হলে খনা থেকে রাণী রাসমণি পর্যন্ত একটানা বিবর্তনের রূপরেখা টানা হবে, কিন্তু এ বিষয়টা লক্ষ্য করার মত, যে তাঁর জন্মক্ষণ আশ্চর্যরকমভাবে এই মাতৃকা-উপাসক জাতির এক প্রাচীন প্রবাদ খনার বচনে লিপ্ত। আরও আশ্চর্য এই যে তখন আগমনী ঋতু, শরৎকালঃ রাণীর জন্ম হয়েছিল ১১ই আশ্বিন, মতান্তরে ১২ই আশ্বিন। 

অতি দরিদ্র ঘরে জন্মেছেন, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই রাসমণির ডাকনাম ছিল রাণী। এগুলো কী বলবেন? যীশুখ্রিষ্ট জন্মের সময় তিনজন ম্যাজাই এসে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন, আর চৈতন্য থেকে রামকৃষ্ণের জন্ম নিয়ে এতগুলো অলৌকিক কাহিনী আছে যার একটাও আমাদের যুক্তিবাদী মন বিশ্বাস করবে না। কাজেই আমাদের এসব নিয়ে কোনও অলৌকিক হেজিওগ্রাফি নির্মাণের দরকার নেই। রাণী কোনও অবতার ছিলেন না, বাঙালি জাতির অশেষ পুণ্যবলে তিনি আমাদের মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছেন বলে বঙ্গ রেনেসাঁস পূর্ণতা পেয়েছিল। যদিও রামকৃষ্ণ বলতেন, রাণী হচ্ছেন অষ্টমাতৃকার একজন (জগদম্বার অষ্ট সহচরী; আসলে আমাদের চৌষট্টি যোগিনীর মধ্যে ব্রাহ্মণ্য-আর্যাবর্তে বিশেষ করে এই আটজনের স্থান রয়েছেঃ ব্রাহ্মী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, ইন্দ্রাণী, চামুণ্ডা, মহালক্ষ্মী)। তবে সেই রামকৃষ্ণই একবার বিষয়চিন্তার জন্য ভর্ৎসনা করে রাণীকে নাকি থাপ্পড় মেরেছিলেন। সমসাময়িক নথি দেখলে জানা যাচ্ছে রামকৃষ্ণের বায়ুরোগের প্রকোপ সন্দেহে এই সময় তাঁকে কামারপুকুরে ফেরত পাঠানো হয়, এবং রামকৃষ্ণের মাতা এইসময় পুত্রের জন্য কিছু টোটকার ব্যবস্থাও করেছিলেন, যাতে বায়ুর প্রকোপ কাটে। রামকৃষ্ণের বিবাহও দেওয়া হয় সারদামণির সঙ্গে এই সময়েই (নিখিলকুমার চক্রবর্তী)। তবে রাণী কিন্তু মাসোহারা বন্ধ করেন নি এই “পাগল ঠাকুরের”।

একে রামকৃষ্ণের বায়ুরোগ হিসেবে দেখব, নাকি তাঁর আচরণে ধ্রুপদী সাংখ্যের প্রকৃতি-বিসর্জনের ডাক হিসেবে দেখব, তা নিয়ে বিতর্কে যাব না এখন। তবে চতুর্বর্গ চিন্তা আমাদের ধর্মীয় আদর্শের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ। কেবল মোক্ষ নিয়ে পড়ে থাকলে সেটা অধর্ম হয়। রাণীর জীবনীকার ডঃ শিশুতোষ সামন্ত বলেন, ব্রাহ্মণের সমদর্শিতা, ক্ষত্রিয়ের ক্ষাত্রতেজ, বৈশ্যের বিষয়বুদ্ধি এবং শূদ্রের সেবা রাণীর মধ্যে সমন্বিত হয়েছিল। রাণী বিষয়চিন্তা করতেন বই কি। অবশ্যই করবেন, রাণী তো। সন্ন্যাসীর মত কাজ করলে স্বধর্মচ্যুত হবেন।

তাঁর স্বামী রাজচন্দ্র দাস যখন আচমকাই স্ট্রোকে প্রয়াত হন, ১৮৩৬ সালে, তিনি ৬৮ লক্ষ টাকা রেখে গেছিলেন, সেই সঙ্গে বেঙ্গল ব্যাঙ্কের ৮ লক্ষ টাকার শেয়ার। এছাড়া দ্বারকানাথ ঠাকুরের বকেয়া ঋণ ছিল ২ লাখ। দ্বারকা-রাসমণি সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি কৌতূকবহ কাহিনী কথিত আছে। ঘটনাটি প্রায় সেযুগের কলকাতায় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিল। বিধবার সম্পত্তি অতি সহজেই করায়ত্ত করা যাবে এই আশায় দ্বারকানাথ ঠাকুর এসে রাজচন্দ্র দাসের প্রয়াণের পর রাণী রাসমণির সম্পত্তি দেখাশোনার প্রস্তাব দেন। দ্বারকানাথ রাসমণিকে পিসিমা বলতেন। রাসমণি বললেন, তা একজন ম্যানেজার তো লাগবেই। কিন্তু আগে সব বকেয়া আদায়ের একটা লিস্টি তৈরি করতে হবে, সেটা হলেই ম্যানেজার রাখব। ভালো কথা, আপনার কাছেও দুই লাখ টাকা পাওনা।

দ্বারকানাথ ভাবলেন বিধবার আস্থাভাজন হতে গেলে এ দুই লাখ অবশ্যই ঝটপট দিয়ে দেওয়া দরকার। তিনি দিয়েও ফেললেন (টাকা নয়, তিনি জমিদারি তালুক লিখে দেন)। সে পাওয়া আদায়ের পরেই রাণী জানিয়ে দেবেন যে সুযোগ্য জামাইরা থাকতে বাইরের কাউকে আর ম্যানেজারি দেওয়া কেন।

মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ এই ঘটনাটির মজাদার বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেখানে দ্বারকানাথকে “ঠগচাচা” আর রাণী রাসমণিকে “টোপীপিসী” নাম দিয়েছেন।

বাঙালির আসলে সেই উদ্ভ্রান্ত, টালমাটাল যুগে এমন একজনেরই দরকার ছিল, যিনি একাধারে চৌষট্টি যোগিনীর একজন হবেন এবং সেই সঙ্গে টোপীপিসীও হবেন। আজও বোধহয় সেরকম একজনের দরকার। পাঠকদের কেউ কেউ এই ব্লাসফেমাস কথা শুনে আঁতকে উঠবেন হয়ত, তা তাঁরা এইখানেই পড়া বন্ধ করে দিতে পারেন।

রাজচন্দ্র দাসের সম্পর্কে বলা হয় তিনি সেযুগে দিনে এক লক্ষ টাকা আয় করেছেন ব্যবসায়। দুশো বছর আগেকার কথা হচ্ছে। দুশো বছর আগেকার এক লক্ষ, আজকের এক লক্ষ নয়। আমরা বাঙালিরা এতদূর হতভাগ্য হয়ে গেছি, যে এই লেখা যাঁরা পড়লেন, তাঁদের মধ্যে দুশো বছর পরে এই মুদ্রাস্ফীতির জমানাতেও এক দিন ছেড়ে এমনকি এক মাসে এক লক্ষ টাকা খুব বেশি লোকে বোধহয় আয় করবেন না। আমি নিজেই করি না, আমিও বর্তমানের অধঃপতিত যুগের এক দরিদ্র জ্ঞানপাপী মরালিস্ট বঙ্গসন্তান।

রাজচন্দ্র একবার এক্সচেঞ্জ অফিসে গিয়ে শুনলেন আফিম নীলাম হবে। সেদিনই উঠল প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টি। আকাশ ভেঙে পড়ছে। মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ী যারা সবাই আসছিল নীলামে দর হাঁকতে, সবাই পথেই আটকে পড়ল। এদিকে নীলাম শুরু হতেই সমস্ত আফিম রাজচন্দ্র কিনে নিলেন ২৫ হাজার টাকায়। এরপর ঝড় বৃষ্টি ধরলে গুটি গুটি পায়ে মাড়োয়াড়িরা এসে পৌঁছল, এবং রাজচন্দ্র খুবই অমায়িকভাবে তাদের কাছে ৭৫ হাজার টাকায় ওই আফিমই বিক্রি করলেন। এক সন্ধ্যায় ৫০ হাজার লাভ। দুশো বছর আগেকার কথা। রাজচন্দ্র দাস আমাদেরই মত বাঙালি ছিলেন, বিশ্বাস হয় না, কারণ যেদিন থেকে বিশ্বমানব হয়েছি সেদিন থেকে আমাদের মধ্যে আর এইরকম কেউ জন্মান না।

কেননা এ জিনিস না বুঝলে আপনি রাণীসম্ভব বুঝতে পারবেন না। আপনি বুঝতে পারবেন না, যেভাবে উৎপল দত্ত তাঁর জাম্বো সাইজের গিরিশ মানসে বুঝতে পারেন নি। যে বইয়ের প্রশংসায় আমি একাধিকবার অতি সঙ্গত কারণেই পঞ্চমুখ হয়েছি এর আগে, কারণ বাংলার হিন্দুর পুনর্জাগরণকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রেক্ষাপটে সমব্যথী ও সপ্রশংস বিশ্লেষণ করেছে এই বই, কিন্তু সেই জাম্বো বইতে রাণী রাসমণি কোথাও নেই। ভাবা যায়? রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে রাণী রাসমণিকে বাদ দিয়ে। এ যেন হেগেল বাদ দিয়ে মার্ক্সের আলোচনা, বা কপিল বাদ দিয়ে বুদ্ধের। যাকগে, প্রসঙ্গে ফিরি।

বৈষয়িক বুদ্ধি রাণী পেয়েছিলেন তাঁর শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে। এগারো বছর বয়সে ১৮০৪ সালে তাঁর বিবাহ। শ্বশুর প্রীতরাম মাড় নিতান্ত দরিদ্র অবস্থায় ব্যারাকপুর অঞ্চল থেকে কলকাতায় এসে জানবাজারে সেযুগের বিখ্যাত জমিদারবাড়ি, অক্রূর মান্নার বাড়িতে ওঠেন। অক্রূর সম্পর্কে ছিলেন প্রীতরামের পিসেমশাই। এই মাহিষ্য জমিদারবংশের আদি নিবাস ছিল গোবিন্দপুর। গোবিন্দপুরে ইংরেজের কেল্লা তৈরি হওয়ার সময় ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়, মান্নারা তাঁদের একজন। প্রীতরাম নিজের চেষ্টায় ভাঙা ভাঙা ইংরেজি শেখেন, স্বীয় বুদ্ধিবলে ইংরেজের মুৎসুদ্দির কাজ করেন এবং তারপর ঢাকায় ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের সেরেস্তাদার, তারপর নাটোর রাজ্যের দেওয়ান। প্রসঙ্গত মাহিষ্যরা অনেকেই দেওয়ানের কাজে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, কারণ কৃষিসংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁদের একটা সহজাত জ্ঞান আছে। এই কারণেই দেখি কৃষিভিত্তিক ব্যবসায় প্রীতরামের বিশেষ সাফল্য। তিনি বাঁশের ব্যবসা করতেন, বেলেঘাটায় ছিল তাঁর বাঁশের আড়ত। মাড় অর্থে বংশগুচ্ছ, জলে ভাসিয়ে এই বাঁশ কলকাতায় নিয়ে আসা হত।

এই বিপুল ধনী পরিবারে হারু ঘরামীর মেয়ে রাণীর আগমন কিভাবে হয়েছিল? প্রীতরামের দুই ছেলে, হরচন্দ্র ও রাজচন্দ্র। রাজচন্দ্রের প্রথম স্ত্রীর অকালবিয়োগের পর পুনর্বার বিবাহ হয়, সেই স্ত্রীও দ্রুত অকালপ্রয়াত হন। ওদিকে হরচন্দ্র নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। প্রীতরাম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এদিকে রাজচন্দ্র আর বিবাহ করতে চাইছিলেন না পরপর শোকগ্রস্ত হয়ে। এমন অবস্থায় গঙ্গাতীরে একাদশবর্ষীয় রাণীকে দেখেন রাজচন্দ্র, এবং মন্ত্রমুগ্ধ হন। খোঁজ নিয়ে জানা যায় স্বজাতি হালিক কৈবর্ত। প্রীতরাম আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ছেলের বিবাহ দেন।

রাণী রাসমণি: কৈবর্তের ঘরে জন্মেছেন কিন্তু কাকে বলে ক্ষাত্রতেজ, দেখিয়ে গেছেন।

রাণী অসীম দারিদ্র‍্য থেকে অতুল বৈভব দেখেছেন। সেজন্য তিনি দরিদ্রের কষ্ট বুঝতেন। প্রকৃত রাজ্ঞী ছিলেন, তিনি রক্ষা করতেন। রাণী সম্পর্কে ডঃ সামন্ত যথার্থ বলেছিলেন, ক্ষাত্রতেজ। বিশদ লিখতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে। রামচন্দ্রের সাগরবন্ধন তো বাঙালি গল্পে পড়েছে। কিন্তু সেযুগের কলকাতায় সেই দৃশ্য দেখতে গঙ্গার তীরে দল বেঁধে জনস্রোত আছড়ে পড়েছিল রাণী যখন কাশীপুর থেকে মেটিয়াবুরুজ অবধি গঙ্গা দশ হাজার টাকায় লিজ নিয়ে গঙ্গা বেঁধে দেন। কারণ কোম্পানি দরিদ্র জেলেদের থেকে জলকর আদায়ের বন্দোবস্ত করেছিল। জেলেরা কলকাতার অনেক বড় মানুষের কাছে দরবার করেছিল, কেউ কর্ণপাত করেন নি। রাণী করেছিলেন। একটি জীবনীতে পড়লাম, সুদূর মহারাষ্ট্রের জেলেরা নাকি এই ঘটনায় উৎফুল্ল হয়ে বাঙালির রাণীকে নিয়ে গান বেঁধেছিল।

রামকৃষ্ণ যদিও বলেছেন অষ্ট নায়িকার একজন। রাণী উনিশ শতকের অদ্বিতীয়া নায়িকা। অশ্বমেধের ঘোড়ার মত তাঁর রূপোর রথ কলকাতা প্রদক্ষিণ করত রথযাত্রার দিন। তাঁর রাজবাড়ির রাস, তাঁর দুর্গোৎসব সেযুগের বাঙালির কার্নিভালঃ তাতে নিধুবাবুর টপ্পা, দাশরথি রায়ের পাঁচালি আর গোবিন্দ অধিকারীর যাত্রা পার্ফরমড হত। লাঠিখেলা, কুস্তি হত, তরোয়ালখেলা হত। তিনি বাঙালির চিরকালের ইতিহাসে মহানায়িকা বলে খ্যাত থাকবেন, এবং সেযুগের কলকাতায় তাঁর জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য দেয় তাঁকে নিয়ে রূপচাঁদ পক্ষীর লেখা গান।

একবার মাতাল গোরা সৈনিকদের দল জানবাজারের রাজবাড়ি আক্রমণ করেছিল, রাণী স্বহস্তে একটি খোলা তরবারি নিয়ে কুলদেবতাকে রক্ষা করেছিলেন, সে তরবারি এখনও তাঁর উত্তরসূরীরা রক্ষা করে রেখেছেন।। তিনি কিংবদন্তী। এরকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেই বলা হয়, স্টাফ দ্যাট লিজেন্ডস আর মেড অফ।

শুধু কলকাতা নয়। নীলকরদের হাতে প্রজারা নিপীড়িত, রাণী লেঠেল পাঠাবেন। প্রজাদের নামে ইংরেজ নীলকর মোকদ্দমা করেছে, রাণী সাহেব ব্যারিস্টার লাগিয়ে মামলা জিতিয়ে দেবেন। আবার বাঙালির দুর্গাপুজোয় নবপত্রিকা নিয়ে বাঙালি গঙ্গায় যাবে, এক সাহেব বাধা দিচ্ছে, রাণী পুরো রাস্তাটা আটকে দিলেন, কারণ বাবুঘাট যাওয়ার ও রাস্তা সত্যিই রাণীর সম্পত্তি। রাণী ইংরেজের কলকাতা বন্ধন করতে পারতেন, রাণী ইংরেজের গঙ্গা বন্ধন করতে পারতেন। তিনি সাধারণ বাঙালির আত্মসম্মানের স্ফুরণ। একবার মাতাল গোরা সৈনিকদের দল জানবাজারের রাজবাড়ি আক্রমণ করেছিল, রাণী স্বহস্তে একটি খোলা তরবারি নিয়ে কুলদেবতাকে রক্ষা করেছিলেন, সে তরবারি এখনও তাঁর উত্তরসূরীরা রক্ষা করে রেখেছেন।। তিনি কিংবদন্তী। এরকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেই বলা হয়, স্টাফ দ্যাট লিজেন্ডস আর মেড অফ।

শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে যখন দেখেছিলেন সেখানে জাতিভেদ নেই, ব্রাহ্মণ-মাহিষ্য একত্রে পংক্তিভোজন করছে, রাণী বলেছিলেন, তাহলে এখানেই থাকব। আসলে তিনি বাঙালির সহজিয়া সাম্যের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর প্রাত্যহিক রুটিনের মধ্যে একটা কাজ ছিল দৈনিক সংবাদপত্র পাঠ এবং সদ্য প্রকাশিত সিরিয়াস প্রবন্ধের বইপত্র পাঠ। তাঁর মাইনে করা পাঠক ছিল। বিদ্যাসাগরের লেখা বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত পুস্তক পাঠান্তে তিনি ব্রাহ্মণ-পাঠককে জিগ্যেস করেছিলেন, বিধবা বিবাহ তো শাস্ত্রসম্মত, তাহলে ব্রাহ্মণরা বাধা দিচ্ছে কেন?

সেযুগে কোনও বব ডিলান ছিল না। তাতে কি, উত্তরগুলো বাতাসে বয়ে গিয়েছিল তবুও। ভাগ্যিস, কবীর সুমনও অবশ্য ছিল না। তবে এ প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা। সংবাদ প্রভাকর ১৮৫৩ সালের মার্চে লিখছে, আশা করা যায় এপ্রিল মে মাস নাগাদ রাণী রাসমণির দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের উদ্বোধন হবে। মন্দির তখন পুরো তৈরি, কালীমূর্তি তো অনেক আগেই তৈরি করে ফেলেছেন নবীন ভাস্কর। প্রসঙ্গত আজ আমরা ভবতারিণী নামে এই বিগ্রহকে জানলেও রাণীর উইলে এই কালীমূর্তির নাম জগদীশ্বরী লেখা আছে।

এ মন্দির তৈরি শুরু হয় ১৮৪৭ সালে। একটি ইংরেজ কোম্পানি, ম্যাকিনটশ বার্নকে দিয়ে বাঙালির আধুনিকযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কালীমন্দির বানিয়েছিলেন কালীপদঅভিলাষী শ্রী রাসমণি দাসী (সই করতেন শ্রীরাষমনীদাশী, তাঁর সিলে তাঁর হস্তাক্ষরে সর্বত্র এই বানান। রাণী সর্বত্র এই বানান লিখতেন, সম্ভবত যাতে কেউ সহজে সই জাল না করতে পারে। তাছাড়া সেযুগে বানানসাম্য ছিল না, বানানবিধির উৎপত্তি হবে আরও পরে)।

রাণীকে মন্দির প্রতিষ্ঠায় বাধা দেওয়া হয়েছিল, কারণ তিনি হালিক কৈবর্ত, মানে মাহিষ্য, অর্থাৎ শূদ্র। কারণ বাংলায় তো ব্রাহ্মণ ছাড়া সবাই শূদ্র, বৃহদ্ধর্মপুরাণ উবাচ। রামকৃষ্ণ নিজেও একবার আক্ষেপ করেছিলেন, কৈবর্তের ভাত খাওয়ালি মা!

মহৎ কার্যে বাধা আসাই পৃথিবীর নিয়ম। সেযুগে একজন বিধবা মাহিষ্যজাতীয় রমণী এই মাতৃকাউপাসক বাঙালির জন্য যে কালীমন্দির স্থাপন করবেন, তাতে বাধা আসবে না, হয় নাকি? প্রসঙ্গত, রাণী যে ব্রাহ্মণকে মন্দির দান করে দিয়ে তবে দক্ষিণেশ্বর উদ্বোধন করেছিলেন, সেটা কিন্তু সত্যি নয়, অন্তত মন্দিরের দলিল অনুযায়ী এটা নিছক মিথ। রাণী নিজে এই মন্দিরের সেবায়েত থেকেই এই মন্দিরের উদ্বোধন করেন, তাঁর উইলেও দেখি তিনি এবং তাঁর কন্যারা বংশানুক্রমে এই মন্দিরের সত্তাধিকারী সেবায়েত থেকে গেছেন। বস্তুত উইলে একাত্তরটি শিডিউল, তাতে তিনি মন্দিরের পূজাবিধির পুঙ্খানুপুঙ্খ দিকনির্দেশ করে গেছেন। 

এ কাজ কঠিন ছিল। ১৮৫৩ সালে মন্দির সম্পূর্ণ হয়ে গেলেও মন্দির উদ্বোধন হয় ১৮৫৫ সালে।

রাণীর জীবনাবসান হয় ১৮৬১ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ১২৬৭ বঙ্গাব্দের ৯ই ফাল্গুন। রাণী মারা গেছেন, তিনি দীর্ঘজীবী হোন, ইংরেজরা এরকম বলে বটে, তাদের রাণীরা পরলোকগত হলে। আমরা বাঙালি, আমরা করজোড়ে প্রার্থনা করব সাংখ্য-আশ্রিত গ্রন্থ গীতার ভাষায়

পরিত্রাণায় সাধূনাম্‌ বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্‌
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে

Feature image- collected.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *