মাতৃভাষার শিক্ষা ব্যবস্থা গঙ্গালাভের পথে আর আপনি মেতে আছেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে - nagariknewz.com

মাতৃভাষার শিক্ষা ব্যবস্থা গঙ্গালাভের পথে আর আপনি মেতে আছেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে


আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পশ্চিমবঙ্গেও ঘটা করে পালিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমেও শোরগোলের কমতি নেই।‌ বাংলা মাধ্যমের সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকা নির্বাহ করে যাঁরা স্বীয় পুত্রকন্যাকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান, তাঁরাও একুশে ফেব্রুয়ারি এলে মাতৃভাষা বাংলার জন্য গর্বে মূর্ছিত হয়ে পড়েন। এদিকে বাৎসরিক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির উৎসাহ উদ্দীপনা যত বাড়ছে, এই রাজ্যে  মাতৃভাষার ভবিষৎ তত‌ই ম্লান হচ্ছে। যে রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এক ধাক্কায় চারলক্ষ হ্রাস পায়, সেই রাজ্যে মাতৃভাষা তো বটেই মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রদত্ত শিক্ষার ভবিষৎ নিয়েও বড় প্রশ্নচিহ্ন উঠে যায়।

ভাষা তো শুধু কাব্য চর্চার মাধ্যম নয় ভাষা জীবনযাপনের‌ও মাধ্যম। যে ভাষা জীবনযাত্রাকে সমৃদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়, সেই ভাষা কালক্রমে ক্ষয় পেতে পেতে একদিন লুপ্ত হয়। বাংলাভাষা দিয়ে আমাদের মন ভরলেও পেট কি ভরছে? আমাদের মাতৃভাষা যদি আমাদের পেট ভরানোর নিশ্চয়তা দিয়েই থাকে তবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দিন দিন নিজেদের ‌দূরে সরিয়ে নিচ্ছে কেন? ২০২২-এ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ১০ লক্ষ ৯৮ হাজার ৭৭৫ জন ছাত্রছাত্রী। তেইশে পরীক্ষার্থীর সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লক্ষ ৯৮ হাজার ৬২৮ জন। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, নয়লক্ষ ছাত্রছাত্রীর নাম নথিভুক্ত হলেও দু’লক্ষ পড়ুয়া মাধ্যমিকের ফর্ম পূরণ করে নি। কোভিড অতিমারি নিঃসন্দেহে পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় এই বিপুল হ্রাসের বড় একটা কারণ। কিন্তু অতিমারি‌ই যে একমাত্র কারণ নয়, তা পর্ষদ‌ও জানে। অতিমারি রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও বিধ্বস্ত করে দিয়েছে মাত্র। অতিমারির আঘাত সত্বেও আইসিএস‌ই, সিবিএস‌ই-র পরীক্ষার্থী সংখ্যা কিন্তু হ্রাস পায় নি। অতিমারিকালে কেন বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি বিকল্প উপায়ে পাঠদান চালু রেখে পড়ুয়াদের ‘ড্রপ আউট’ রোধে ব্যর্থ হল, এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় কি পর্ষদের নয়?

বাঙালি মধ্যবিত্ত যে বাংলা মাধ্যম স্কুল মোটের উপর ছেড়ে দিয়েছে এবং একটু আর্থিক সঙ্গতি থাকলেই যে মধ্যবিত্ত অভিভাবক  ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করে দিচ্ছে, তা আর লুকোছাপা করার জায়গায় নেই। কলকাতা মহানগরী তো বটেই এমনকি জেলা শহরগুলিতেও বাংলা মাধ্যমের স্কুলে স্কুলে পড়ুয়াদের খরা। এবং এই বৃত্তটা ক্রমেই বড় হচ্ছে। যে হারে প্রতি বছর পড়ুয়ার সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, তা চলতে থাকলে আগামী দশ‌ বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলগুলিতে অধিকাংশ সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুল পোড়ো বাড়িতে পরিণত হবে। হয়তো সরকার স্কুলগুলির জমিবাড়ি অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার পরিকল্পনা নেবে।

শহর-গ্রাম বলে আসলে কোনও কথা নেই। একটু সামর্থ্য থাকলেই মানুষ এখন ছেলেমেয়েদের জন্য ইংরেজি মাধ্যম বেছে নিচ্ছেন। যেদিন থেকে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্তদের আশা-ভরসার জায়গা থেকে বাংলা মাধ্যম সরতে শুরু করল, সেদিন থেকেই সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার অবনমনের শুরু। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁদের সন্তানদের বাংলা মাধ্যমে পড়ান না। তাঁরা রোজগার করছেন বাংলা মাধ্যমে পড়ানোর চাকরি করে কিন্তু রোজগারের টাকা ব্যয় করছেন ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শেখাতে। কী কী পদক্ষেপ করলে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা অটুট থাকে, কোনও সরকার সেইসব পদক্ষেপ করে নি। তার ফল যেটা দাঁড়িয়েছে, আজ রাজ্যের পুরো  শিক্ষা ব্যবস্থাটার‌ই গুণমান তলানিতে ঠেকেছে।

যে মাধ্যম থেকে সমাজের স্বচ্ছল, শিক্ষিত অংশ সরে এসেছে, সেই মাধ্যমের ভালমন্দ নিয়ে তাঁরা চিন্তিত হবে কেন? ইংরেজিতে  ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড’ বলে একটা কথা আছে। সরকার পড়ালেখা সাব-স্ট্যান্ডার্ড করে দিয়ে কৃতিত্ব নিচ্ছে। পরীক্ষার ফলে গোঁজামিল দিয়ে আনন্দ পাচ্ছে। পড়ুয়াদের শেখার আগ্রহ নেই। শিক্ষকদের শেখানোর দায় নেই। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি। দুর্নীতির জেরে মামলা-মোকদ্দোমা। মামলার জেরে বন্ধ শূন্য পদে নিয়োগ। পরিস্থিতি ঘেঁটে এমন ঘ হয়ে গেছে যে হাইকোর্টের বিচারপতি পর্যন্ত ভরা এজলাসে কটাক্ষ করে বলছেন, স্কুলে স্কুলে ছাত্র‌ই তো নেই, নতুন করে শিক্ষক নিয়োগের দরকার কী!

আপনি বাঙালি হিসেবে গর্বিত। ঠিক আছে। আপনি একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলা ভাষার জন্য গর্ব বোধ করছেন। ঠিক আছে। বাঙালি বঞ্চিত বলে আপনার হৃদয় ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। ঠিক আছে। কিন্তু বাঙালি ছেলেমেয়েরা যখন বাংলা মাধ্যম স্কুলে নিম্ন মানের শিক্ষা পাচ্ছে, আপনি মেনে নিচ্ছেন কেন? আপনি ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন বাংলা মাধ্যমে পড়লে আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ গোল্লায় যাবে। তাই আপনি আপনার সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করে দিয়ে একটু নিশ্চিন্ত আছেন। আপনি আরাম করে বাঙালিয়ানার ডাঁটা চিবুচ্ছেন। এদিকে একটা বাঙালি প্রজন্ম এমন শিক্ষা পাচ্ছে, যা তাদের পথে বসানো ছাড়া আর কোনও ব্যাপারে ভবিষ্যতে সাহায্য করবে না। মাতৃভাষায় পড়ালেখা করে যদি ছেলেমেয়েরা মানুষ না হয়, তবে মাতৃভাষার মহিমা আর কতদিন অক্ষুণ্ণ থাকবে? মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রদত্ত শিক্ষা ব্যবস্থা যদি শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষা ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়, তবে মাতৃভাষার প্রতি আলগা পিরিত দেখিয়ে কী লাভ? মাতৃভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া শিখে যদি আমাদের ছেলেমেয়েদের জীবনযুদ্ধে জেতার আত্মবিশ্বাস‌ই তৈরি না হয়, তবে সেই মাতৃভাষা দিয়ে আমরা কী করিব? মাতৃভাষা নিঃসন্দেহে মাতৃদুগ্ধ সমান। কিন্তু মাতৃদুগ্ধ বাঙালি শিশুদের সবল   করতে ব‌্যর্থ হলে প্রতিকারের রাস্তা না খুঁজে একদিন ফাগুন প্রভাতে  ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো…’ গান গেয়ে শুয়ে পড়লে চলবে?

Feature Image is Representational. Image Source- Collected.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *