২০০৭ সালে পাকিস্তানের কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠী এক ছাতার তলায় এসে তৈরি করে তেহিরিক-ই-তালিবান-ই-পাকিস্তান।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পাকিস্তানের পেশোয়ারের ‘হাই সিকিউরিটি জোন’ বলে পরিচিত পুলিশ লাইন এলাকার মসজিদে ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৯৬। সোমবার দুপুরে যোহরের নামাজের সময় এই আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়। সন্ধের মধ্যেই ঘটনার দায় স্বীকার নেয় তেহিরিক-ই-তালিবান-ই-পাকিস্তান (টিটিপি)। তালিবানের পাকিস্তানি সংস্করণ এই খতরনাক জঙ্গি গোষ্ঠী এখন পাক প্রশাসনের সব থেকে বড় মাথা ব্যথার কারণ। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে টিটিপি বা পাক তালিবর অস্তিত্ব অনেক দিন ধরেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের হামলার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে তালিবানরা আফগানিস্তানে ফের ক্ষমতায় আসার পর খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে এদের নিয়ে রীতিমতো নাজেহাল অবস্থা পাকিস্তান সরকারের।
তালিবানের জন্মলগ্ন থেকেই তাদের রসদদারের ভূমিকায় পাকিস্তান। ২০০১– এ মার্কিন অভিযানের পর তালিবানরা কাবুল থেকে বিতাড়িত হয়। কাবুলে তালিবান বিরোধী যে সরকার একুশের অগাস্ট পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিল ইসলামাবাদের সঙ্গে সঙ্গত কারণেই তাদের সম্পর্ক ছিল খারাপ। সেই সরকারকে অস্থিতিশীল করতে গত বিশ বছরে তালিবানকে নানাভাবে মদত দিতে কার্পণ্য করে নি পাকিস্তান সরকার এবং সেনাবাহিনী। দুই দশক ক্ষমতার বাইরে থাকলেও আফগানিস্তানের একটি বড় অংশ তালিবানের দখলেই ছিল। সে সময়কালের মধ্যেই তেহেরিক-ই-তালিবান, পাকিস্তান বা পাক তালিবানের জন্ম। ধীরে ধীরে তারা শক্তি সঞ্চয় করেছে।
আমেরিকার চাপের মুখে পারভেজ মোশাররফের সরকার যখন জঙ্গি দমনে সক্রিয় হন, তখন থেকেই পাকিস্তানের একাধিক মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওয়াশিংটন প্রশাসনকে পাকিস্তান বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে দেখে একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠী ২০০৭ সালে এক ছাতার তলায় এসে ‘তেহেরিক-ই-তালিবান-ই-পাকিস্তান’ গঠন করে। সেই সময় আমেরিকার ঠ্যালা খেয়ে আফগানিস্তানের তালিবানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে ইসলামাবাদ। টিটিপি-র অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, আফগান তালিবানদের মদত জুগিয়ে যাওয়া। পাকিস্তান সরকার তালবানের পেছন থেকে সরে এলেও আর্মি ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর অনেকেই ছিলেন তালিবানের প্রতি সহানুভূতিশীল। পাক সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের এই অংশটিরও তলে তলে সহযোগিতা পায় টিটিপি। মতাদর্শগত দিক দিয়ে টিটিপি কট্টর সুন্নি ওয়াহাবিজমে বিশ্বাসী। কোরান ও শরিয়তের বিধানের এক ইঞ্চি লংঘনও তারা বরদাস্ত করতে রাজি নয়।
টিটিপি-কে দমাতে গিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে ইসলামাবাদ
দীর্ঘ সময় ধরে পাকিস্তান রাষ্ট্র কখনও প্রতিবেশী ভারতকে কখনও আফগানিস্তানকে টাইট দিতে বিভিন্ন কিসিমের ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনকে মদত দিয়ে এসেছে। এখন পাকিস্তান এদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলেও পারছে না। কারণ পাকিস্তানের সমাজের বৃহদাংশ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জঙ্গিকরণের (radicalisation) কাজটি বেশ ভালভাবেই সারা হয়ে গেছে। যে তালিবানকে ফের ক্ষমতায় বসতে পাকিস্তান সাহায্য জুগিয়েছে এখন সেই তালিবান পাকিস্তান সরকারের মজা বোঝাচ্ছে। একুশের অগাস্টে কাবুল বিজয় সম্পূর্ণ হয়ে যায় তালিবানের। এর পর থেকেই খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে পাক তালিবানের বাড়াবাড়ি শুরু। টিটিপি-কে দমন করতে আর্মি নামায় ইসলামাবাদ। টিটিপি-র জঙ্গিরা আফগানিস্তানে আশ্রয় নিতে শুরু করে। টিটিপি-কে কেন্দ্র করে কাবুলের তালিবান সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি হতে দেরি হয় নি।
জঙ্গি নিকেশ করতে বেশ কয়েকবার সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানি ফৌজ আফগানিস্তানে ঢুকে যায়। বিষয়টি মেনে নেয় নি তালিবান সরকার। পাকিস্তানের সঙ্গে পেয়ার-মহাব্বতের দিনগুলির কথা ভুলে গিয়ে তালিবানের মিলিশিয়া বাহিনী সীমান্তে পাকিস্তান ফৌজের চৌকি লক্ষ্য করে গোলাগুলি ছুড়তে দ্বিধা করে নি। ইতিমধ্যেই পাক-আফগান সীমান্তে বেশ কয়েকবার দুই তরফে সংঘাতের ঘটনা ঘটে গেছে। পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কের অবনতির মধ্যেই খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ জুড়ে টিটিপি-র তৎপরতা বেড়ে গেছে। সোমবার মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর টিটিপি জানিয়েছে, দলের কমান্ডার উমর খালিদ খুরাসানির হত্যার বদলা নিতেই এই হামলা। ২০২২-এর অগাস্টে আফগানিস্তানের পাকটিকা এলাকায় ঢুকে খুরাসানির কনভয়ে হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনা। হামলায় খুরসানি নিহত হয়।
কে এই উমর খলিল খুরাসানি?
উমর খালিদ খুরাসানির প্রকৃত নাম আব্দুল আলি মহম্মদ। করাচির এক মাদ্রাসায় পড়তে পড়তেই ইসলামিক জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হয় সে। প্রথমে যে জঙ্গিদলে খুরাসানি নাম লিখিয়েছিল, তার নাম হরকত-উল-মুজাহিদিন। এদের কাজ কাশ্মীর সহ ভারতের সর্বত্র নাশকতা ঘটানো। হামলার মিশন নিয়ে খুরাসানি কাশ্মীরেও ঢুকেছিল বলে জানা গেছে। পরে তেহেরিক-ই-তালিবানে ভিড়ে যায় সে। টিটিপি-র একটি শাখা সংগঠন আছে জামাত-উল-আহরা নামে। পাকিস্তান জুড়ে শিয়া ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালাতে এটি তৈরি করেছিল খুরাসানি। ২০১৬ সালে লাহোরের গুলশান-ই-ইকবাল পার্কে হামলা চালিয়ে ৭০জনেরও বেশি নিরপরাধ অসামরিক মানুষকে হত্যা করেছিল সংগঠনটি। আমেরিকার মোস্ট ওয়ান্টেড টেররিস্টের তালিকাতেও এই খতরনাক জঙ্গির নাম ছিল। আমেরিকা খুরাসানির মাথার দাম ধরেছিল ৩০ লক্ষ ডলার।
খুরাসানিরা নিকেশ হলেও জঙ্গি সংগঠন ধ্বংস হয় না। খুরাসানির ভাই মোকাররমও দাদার পথেই আছে। দাদার মৃত্যুর বদলা নিতে নাকি তক্কে তক্কে ছিল মোকাররম। সোমবার সুযোগ আসতেই কাজে লাগায় সে। দলের দুই সদস্যকে ‘মানব বোমা’ হিসেবে ব্যবহার করে মসজিদ উড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানের গোয়েন্দারা যদিও বলছে মসজিদ নয় পুলিশের সদর দফতরই নিশানা ছিল জঙ্গিদের। কিন্তু ভুল করে মসজিদে প্রার্থনারত মুসুল্লিদের উড়িয়ে দিয়ে তারা ভীষণ অনুতপ্ত, এমন বার্তা টিটিপি-র তরফ থেকে কিন্তু দেওয়া হয় নি। প্রতিশোধ নিতে মসজিদ ধ্বংসও তাদের কাছে জায়েজ।
Feature Image Credit- Dawn.