ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল গান্ধীর লক্ষ্য মোদী হলেও বাংলায় সাগর থেকে পাহাড় যাত্রায় অধীরের আক্রমণের মূল লক্ষ্য কিন্তু মমতা
বিশেষ প্রতিবেদন: রাহুল গান্ধী পথে। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর- ভারত জোড়ো যাত্রায়। গন্তব্যে না পৌঁছে থামবেন না রাহুল। রাহুলের পদযাত্রা কাশ্মীরে গিয়ে শেষ হবে কিন্তু তাঁর আসল গন্তব্য যে ঘরের কাছেই সাউথ ব্লক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাহুল গান্ধীর যাত্রাপথে বাংলা পড়ছে না। তবে দীর্ঘদিন পর বাংলায় বড় কর্মসূচি নিল পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস। অনুপ্রেরণা অবশ্যই রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রা। বুধবার সাগর থেকে পাহাড় পদযাত্রার সূচনা করলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী। গঙ্গাসাগর থেকে যাত্রার শুরু। ২৩ জানুয়ারি তা শেষ হওয়ার কথা কার্শিয়াং-এ।
বাংলায় কংগ্রেস হ্রাস পেতে পেতে শেষ পর্যন্ত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ আর মালদহ জেলায় ঘাঁটি টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। লোকসভায় এই দুই জেলা থেকে কংগ্রেসের দুই প্রতিনিধি থাকলেও বিধানসভায় শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে। বাম আমলে মমতা দল ছাড়ার আগে পর্যন্ত রাজ্যে কংগ্রেসের ভোট ছিল ৪০-৪২ শতাংশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গঠনের পর কংগ্রেসের ভোটের বৃহদাংশ তৃণমূলের দখলে চলে যায়। এগারোয় কংগ্রেস মমতার সঙ্গে হাত না মেলালে তৃণমূলের পক্ষে একার চেষ্টায় ক্ষমতায় আসা কঠিন ছিল বলেই মনে করে রাজনৈতিক মহল। ক্ষমতায় এসে কংগ্রেসের অবশিষ্ট শক্তিও নিঃশেষ করার পরিকল্পনা করেন মমতা। ফলে দুই বছরের মাথাতেই দুই দলে রাজনৈতিক মধু চন্দ্রিমার অবসান। এরপর ফারাক্কা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ষোলোর বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসে জোট হয়। জোটের ফল শোচনীয় হলেও ৪২টি আসন পেয়ে বিধানসভায় বিরোধী দলের মর্যাদা পায় কংগ্রেস। যদিও তাতে বাংলায় কংগ্রেসের রাজনৈতিক শক্তি এক চুলও বাড়ে নি। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসকে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত করে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে ওঠে বিজেপি। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর দেখা গেল, বাংলার পরিষদীয় রাজনীতি থেকে বাম ও কংগ্রেস উভয়েই বিতাড়িত।
নিয়োগ দুর্নীতি থেকে পঞ্চায়েতে একশ দিনের কাজ ও আবাস যোজনায় ঘোটালার জেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে যথেষ্টই বেকাদায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীও যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ততটা সাড়া দিচ্ছে না, সেই আভাসও স্পষ্ট। সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। তারপর লোকসভা নির্বাচন। এই পরিস্থিতিতে বামেরা ঘুরে দাঁড়ানোর মরীয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। সাগর থেকে পাহাড় যাত্রা দেখে মনে হচ্ছে কংগ্রেসও আর বসে থাকতে রাজি নয়। এই রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটের একটা বড় অংশ বরাবরই কংগ্রেসের দখলে ছিল। ফলে ঘোর বাম জামানাতেও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও উত্তর দিনাজপুর জেলায় ভাল ফল করত কংগ্রেস। সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের ঘর থেকে ফিরিয়ে আনতে পারলে ফের এই সব জেলায় কংগ্রেস পায়ের তলায় শক্ত মাটি খুঁজে পাবে বলে মনে করছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব। তাই ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল গান্ধীর লক্ষ্য মোদী হলেও বাংলায় সাগর থেকে পাহাড় যাত্রায় অধীরের আক্রমণের মূল লক্ষ্য মমতা।
চব্বিশে মোদী বিরোধী লড়াইয়ে মমতাকে পাশে পাওয়ার আশা বহু আগেই ত্যাগ করেছেন সোনিয়া-রাহুল। বাংলার কংগ্রেস নেতাদের মমতা বিরোধিতায় তাই আর লাগাম টানতে চান না তাঁরা। বরং মমতার সরকারের বিরুদ্ধে অল আউট আক্রমণে গেলে বাংলায় দল কিছু ডিভিডেন্ড পেলেও পেতে পারে- এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা। এখন রাজ্যের যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সুর না চড়ালে বিরোধী দলের কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি সফল করা মুশকিল। গঙ্গাসাগর থেকে শুরু হওয়া পদযাত্রা রাজ্যের দশটি জেলা অতিক্রম করবে। ২৫ দিন ধরে যাত্রা চলবে। জন সংযোগ স্থাপনে নিঃসন্দেহে পদযাত্রার বিকল্প নেই। প্রদেশ কংগ্রেস শেষ কবে এত বড় কর্মসূচি নিয়েছিল, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তা মনে করতে পারছেন না।
বুধবার ছিল জাতীয় কংগ্রেসের ১৩৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সেই দিনই ভারত জোড়ো যাত্রার বঙ্গীয় সংস্করণের সূচনা করলেন অধীর চৌধুরী। যাত্রা শুরুর আগে সমাবেশে অধীর চৌধুরী বলেন, বাংলা লুটছে তৃণমূল আর ভারত লুটছে বিজেপি। দুর্নীতি ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বাংলার মানুষকে আর কিছুই উপহার দেয় নি বলে অভিযোগ করেন অধীর। সাগর থেকে পাহাড় যাত্রা যত দীর্ঘ হতে থাকবে, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির মমতা বিরোধিতার ঝাঁঝ ততই বাড়তে থাকবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
Feature Image – Collected.