ডেস্ক রিপোর্ট: ১৫ বছর পর দিল্লি পুরনিগম হাতছাড়া বিজেপির। এক্সিট পোলের পূর্বাভাস সত্য প্রমাণ করে এমসিডি দখল করল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ। দিল্লি সরকারের পর দিল্লি পুরনিগমও নিয়ন্ত্রণে নিল কেজরিওয়ালের পার্টি। চব্বিশে কেন্দ্রীয় সরকার কব্জা করার লক্ষ্যে বহুদিন হল ঘর ছেড়ে পথে রাহুল। ভারত জোড়ো যাত্রায় নেমে ইতিমধ্যেই দু’হাজার কিলোমিটারের বেশি হেঁটে ফেলেছেন সোনিয়া পুত্র। এদিকে দেশের রাজধানীর পুরভোটে কংগ্রেস কার্যত সাফ। দিল্লি উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব নগরনিগমের ২০১৭-র ভোটে আসন সংখ্যা ছিল ২৭০, তিনটি পৃথক নিগম ভেঙে দিয়ে এমসিডি গঠনের পর ২০২২-এর ভোটে আসন কমে দাঁড়িয়েছে ২৫০। এর মধ্যে আম আদমি পার্টি পেয়েছে ১৩৪টি। বিজেপি ১০৪। কংগ্রেসের ঝুলিতে মাত্র ৯টি ওয়ার্ড। অন্যান্যরা ৩টি।
হাতের ভোট কাচিয়ে নিয়েছে ঝাড়ু
ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সবথেকে ক্ষতি হয়েছে কংগ্রেসের। ২০১৭-য় কংগ্রেস ৩০টি ওয়ার্ডে জিতেছিল। এবার কমে মাত্র নয়! একুশটি ওয়ার্ড হাতছাড়া হাতের। এবার কংগ্রেসের ভোট ১১.৬৪ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে ছিল ২১.০৯ শতাংশ। ২০১৭-র তুলনায় কংগ্রেসের ভোট কমেছে ৯.৪৫ শতাংশ। শতাংশের বিচারে কংগ্রেসের ভোট কমলেও বেড়েছে আপ ও বিজেপির। সতেরোর পুর নির্বাচনে আপের ভোট ছিল ২৬.২৩ শতাংশ। এবার বেড়ে হয়েছে ৪২.২০ শতাংশ। ১৬ শতাংশ ভোট বাড়ানো যেমন-তেমন কথা নয়। আগের ভোটে আপ পেয়েছিল ৪৮টি আসন। এবার ১৩৪। ৮৬টি আসন বাড়িয়ে নিয়েছে আম আদমি পার্টি। পুরনিগম হাতছাড়া হলেও ভোট বেড়েছে বিজেপিরও। আগেরবার বিজেপি পেয়েছিল ৩৬.০৮ শতাংশ ভোট। এবার পদ্মের ভোট বেড়ে হয়েছে ৩৯.১২ শতাংশ। গত পুরভোটের তুলনায় বিজেপির ভোট বেড়েছে ৩.০৪ শতাংশ বাড়লেও আসন কমেছে ৭৮টি। হাতের যে ভোট মাইনাস হয়েছে, তার পুরোটাই ঝাড়ু কাচিয়ে নিয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। নিঃসন্দেহে যা দিল্লি নগরনিগম থেকে বিজেপিকে বিদায় করতে কেজরিওয়ালের সুবিধা করে দিয়েছে।
২০১২ সালে দিল্লি পুরনিগমকে উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব- পৃথক তিনটি পুরনিগমে ভাগ করেছিল মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের সরকার। ২০২২-এর ২২ মে তিনটি নিগমকেই ফের একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে এমসিডি বা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অব দিল্লি গঠন করে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৫-র পর ২০- দিল্লি বিধানসভার পর পর দুটি নির্বাচনে কেজরিওয়ালের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর নগর নিগম ধরে রাখা ছিল বিজেপির জন্য প্রেস্টিজ ইস্যু। বুধবার ভোটের ফল প্রকাশের পর পরিস্কার- সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে হার হয়েছে পদ্ম শিবিরের। ২০১৩-য় প্রথমবারের মতো দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শিতে বসেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। প্রথম দফায় মাত্র দেড় মাস টিকেছিল কেজরিওয়ালের সরকার। ২০১৫-র নির্বাচনে প্রত্যাশার বাইরে বিপুল সাফল্য আপের। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে খাতা খুলতে ব্যর্থ কেজরিওয়াল ফের ধামাকা দিলেন বিশের বিধানসভা ভোটে।
শিক্ষা-স্বাস্থ্য ভাল করার ডিভিডেন্ড পেয়েই যাচ্ছেন কেজরিওয়াল
কেজরিওয়ালের প্রতি দিল্লিবাসীর এই আস্থার কারণ কী? দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর দাবি- পজিটিভ পলিটিক্স, যা দিল্লির জনগণ চান। প্রশাসনিক ইস্যুতে একাধিকবার কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে দিল্লি সরকারকে। পুরভোটের আগে দুর্নীতির অভিযোগে ধৃত দিল্লি সরকারের মন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈনের স্টিং ভিডিও ফাঁস করে বিজেপি। ভিডিওতে দেখা যায়, তিহাড় জেলে বন্দী সত্যেন্দ্র জৈনের পা মালিশ করে দিচ্ছে কেউ। আর্থিক তছরুপের অভিযোগে ইডির হাতে ধৃত আপের মন্ত্রী জেলের ভেতরেও বেআইনিভাবে সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন- এই ছিল দিল্লির বিজেপি নেতাদের অভিযোগ। যদিও এই অভিযোগ মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। দেখা গেল, ভোটের আগে স্টিং অপারেশন করেও আপকে বাঁশ দিতে ব্যর্থ বিজেপি।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল ও বিদ্যুৎ- এই চারটি পরিষেবা সুলভ ও দুর্নীতিমুক্ত করার অঙ্গীকার করেই দিল্লির নাগরিকদের প্রথম মন জয় করেছিল বিজেপি। কেজরিওয়াল দিল্লির দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারি স্কুলে পড়ালেখার মানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। দিল্লি সরকার পরিচালিত হেল্থ ক্লিনিকগুলির প্রতিও আস্থা বেড়েছে সাধারণ মানুষের। সরকারে এসে জন পরিষেবা উন্নত করার ডিভিডেন্ডই বারবার কেজরিওয়ালকে সসম্মানে ভোট বৈতরণী পার করাচ্ছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।
দিল্লি এখন আপ আর বিজেপির
আপ যে দিল্লির স্থায়ী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, নগরনিগমের ভোটের ফলে তা আরও একবার প্রমাণিত। দিল্লিতে এখন রাজনৈতিক শক্তি বলতে আপ আর পদ্মই। একসময় দিল্লি ছিল কংগ্রেসের দুর্ভেদ্য দুর্গ। দিল্লির ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ আগে ছিল জনসংঘের ভোট ব্যাঙ্ক। পরে বিজেপির। রাজধানীর ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ভোট যে এখন আপ ও বিজেপির মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে, একাধিক ভোটের ফলে তার প্রমাণ মিলেছে। দুই-একটা সংখ্যালঘু মহল্লা বাদ দিলে দিল্লিতে আর কোথাও কংগ্রেসের পায়ের নিচে মাটি নেই। দিল্লি ছাড়িয়ে কেজরিওয়ালের নজর এখন রাজ্যে রাজ্যে। ইতিমধ্যেই পাঞ্জাবে আপ সরকার প্রতিষ্ঠিত। আইআইটির প্রাক্তনীর পরের টার্গেট দিল্লির পাশের রাজ্য হরিয়ানা। গুজরাট নির্বাচনেও যথেষ্ট শক্তি খরচ করেছে আম আদমি পার্টি। তবে এক্সিট পোল বলছে, মোদীর রাজ্যে তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে কেজরিওয়ালকে। যদিও আপ বড় সংখ্যায় কংগ্রেসের ভোট কেটে গুজরাটে বিজেপির জয়কে অনেক বেশি প্রশস্ত করে দিতে পারে- এমনও আভাসও উঠে এসেছে এক্সিট পোল থেকে।
Feature Image is representational.