কোচবিহার রাসমেলার বয়স ১৩২ হলেও রাস উৎসব ২১০ বছরে পড়ল
বিশেষ প্রতিবেদন: কোচবিহারের ইতিহাস মানেই কোচ রাজাদের কাহিনী। কোচবিহারে রাস উৎসব ও রাসমেলার সূচনাও কোচ রাজবংশের রাজাদের হাত ধরে। ঐতিহাসিকেরা বলেন, ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহারে রাস উৎসবের সূচনা করেন মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ। কোচবিহার শহরের বর্তমান মদনমোহন মন্দিরটি উদ্বোধন করেন মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ। সেই বছরই রাস পূর্ণিমা তিথিতে মন্দিরে রাস উৎসবের সূচনা। রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে মন্দির সংলগ্ন বিরাট মাঠে মেলা বসতে শুরু করে তখন থেকেই। ১৯১৭ সাল থেকে মেলা স্থানান্তরিত হয় প্যারেড গ্রাউন্ডের মাঠে,যা এখন রাসমেলার মাঠ নামে পরিচিত। কোচ রাজারা ধর্মাচরণে ছিলেন বৈষ্ণব। শ্রীশ্রী মদনমোহনের রাসযাত্রা স্বাভাবিক ভাবেই তাই রাধাকৃষ্ণের রাস বা কৃষ্ণ রাস। ১৮৯০ সাল থেকে মদনমোহন মন্দিরে সাড়ম্বরে রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও কোচবিহারে রাস উৎসবের সূচনা ধরা হয় ১৮১২ সালকেই । সেই হিসেবে এ’বার কোচবিহারের রাস উৎসব ২১০ বছরে পড়ল। ১৮১২ সালের রাস পূর্ণিমা তিথিতে কোচবিহারের ভেটাগুড়িতে নব নির্মিত রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছিলেন মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ। সেই থেকেই রাজাদের রাস উৎসবের শুরু । যা আজ উত্তর-পূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ মেলায় পরিণত হয়েছে।
কোচবিহারের রাসমেলার অন্যতম আকর্ষণ হল ‘রাসচক্র’। রাজার আমলে কোচ রাজবংশের মহারাজা রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসব ও মেলার উদ্বোধন করতেন। রাজতন্ত্রের অবসানের পরেও এই রেওয়াজ বজায় ছিল। ১৯৬৯ পর্যন্ত প্রাক্তন কোচবিহাররাজই রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করতেন । এখন এই কাজটি করেন কোচবিহারের জেলা শাসক। রাসচক্র নির্মাণের গোটা দায়িত্বটি একজন মুসলমান ধর্মাবলম্বীর কাঁধে। নাম আলতাফ মিঞা। আলতাফের বাপ-ঠাকুর্দাও রাসচক্র বানিয়েছেন। এখন আলতাফ বানান। আলতাফ মিঞার বাড়ি কোচবিহার শহরের হরিণচওড়া এলাকায়। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন থেকে রাসচক্রটি বানানোর কাজে হাত লাগান তিনি। একমাস নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন আলতাফ। বিরাট রাসচক্রটি ২৯ ফুট লম্বা। বাঁশের কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে থাকে ঘূর্ণায়মান চক্রটি। বাতার পরিকাঠামোর উপর রঙ-বেরঙের কাগজের নক্সা দিয়ে রাসচক্র অলংকৃত। চক্রের মাথার উপর ছত্রাকার আচ্ছাদন। বাঁশের হাতল ধরে রাসচক্রটি ঘুরিয়ে থাকেন ভক্তরা।
রাসমেলার আরও একটি আকর্ষণ হল পুতনা রাক্ষসীর বিশালাকার মূর্তি। মদনমোহন মন্দির চত্বরেরই এক প্রান্তে পুতনা মূর্তির দর্শন মেলে। পুতনার ভয়াল মূর্তি দর্শন না করে কেউ মেলার মাঠ ছাড়ে না। রসনার দিক থেকে কোচবিহারের বিখ্যাত রাসমেলার সবথেকে বড় আকর্ষণ হল জিলিপি। কোচবিহার জেলা জিলিপির জন্য বিখ্যাত। কোচবিহারের মধ্যে আবার সবথেকে উৎকৃষ্ট জিলিপি তৈরি হয় ভেটাগুড়িতে। রাসমেলার মাঠে ভেটাগুড়ির কারিগরেরা বসেন জিলিপির পসরা সাজিয়ে। ভেটাগুড়ির জিলিপির কারিগরদের সঙ্গে মেলায় কম্পিটিশন লাগিয়ে দেন বাবুরহাট , দেওয়ানহাট এবং পুন্ডিবাড়ির কারিগরেরা। তবে মেলা দর্শনার্থীদের কাছে ভেটাগুড়ির জিলিপির কদরই আলাদা। সবাই মেলার মাঠে গিয়ে ভেটাগুড়ির জিলিপির খোঁজ করে।
মদনমোহন হলেন কোচ রাজবংশের কুলদেবতা। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের ভেটাগুড়িতে রাজধানী স্থানান্তর করেন মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ । অগ্রহায়ণ মাসে রাস পূর্ণিমার সন্ধ্যায় মানসাই নদী অতিক্রম করে সপরিবারে নতুন রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন মহারাজা। সেই মুহুর্তেই মদনমোহনের রাস উৎসবের সূচনা করেন মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ। কোচবিহারের ঐতিহাসিক রাসমেলার কেন্দ্রবিন্দু হল মদনমোহন মন্দির। কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্টের অন্যতম প্রতিনিধি জয়ন্ত কুমার চক্রবর্তী জানিয়েছেন, মদনমোহন মন্দিরে পাঁচটি কক্ষ রয়েছে। একেক কক্ষে একেক দেবীর বিগ্রহ। পূর্ব প্রান্তে জয়তারা। পশ্চিম প্রান্তে কালী বিগ্রহ। আরেক পাশে মা ভবানীর বিগ্রহ। মন্দিরের মূল কক্ষে বিরাজ করেন বিগ্রহরূপী মদনমোহন। বিগ্রহটি রুপোর তৈরি। মদনমোহনের বিগ্রহ আবার দুটি- একটি বড় মদনমোহন, আরেকটি ছোট মদনমোহন । ছোট মদনমোহন সারা বছর অন্তরালেই থাকেন। একবারই তিনি জেগে ওঠেন, এই রাস উৎসবের সময়। মদনমোহন মন্দিরের অন্যদিকে নাটমন্দির। নাটমন্দিরে দুর্গাপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। মন্দিরের পাশেই বৈরাগীদিঘি। আগে এই দিঘিতেই সেবাইত ও ভক্তরা স্নান করতেন। আগে ভক্তদের জন্য থাকত বিশেষ তাঁবুর ব্যবস্থা। এখন তাঁদের জন্য তৈরি করা হয়েছে বিরাট আনন্দময়ী ধর্মশালা।
কোচবিহার রাজাদের রাসমেলার বর্তমান পরিচালক কোচবিহার পুরসভা। মদনমোহন মন্দিরের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে দেবোত্তর ট্রাস্ট। করোনার কারণে বিশে মেলা বসেছিল নামমাত্র। একুশে মেলা বসলেও প্রশাসনের তরফে নানা বিধিনিষেধ ছিল। বাইশে করোনা মুক্ত কোচবিহারের ঐতিহ্যবাহী রাসমেলা ফের স্বমহিমায়। যেই হেতু বিশের রাসমেলা ছিল নমো-নমো। একুশে মেলা বসলেও প্রাণ খুলে আনন্দ করা যায় নি। তাই এই বছর রাসমেলা ২০ দিনের। সোমবার রাতে মদনমোহনের পুজো শেষে রাসচক্র ঘুরিয়ে রাসো উৎসবের সূচনা করেন কোচবিহারের জেলাশাসক পবন কাদিয়ান। মেলায় স্টল থাকছে এক হাজারের বেশি। সাংস্কৃতিক মঞ্চে প্রতিদিনই জমিয়ে বসবে গানবাজনার আসর।