দিল্লি ও আশপাশের এলাকাগুলি দিনে একবার করে হলেও AQI লেভেল ৩০০ অতিক্রম করে ফেলছে। যা ৫০-এর কম থাকা প্রয়োজন। এবং এরকম অবস্থা চলতে থাকবে মার্চ মাস অবধি। নিজের অভিজ্ঞতার কথা আরও যা জানালেন ঋতুপর্ণা কোলে-
আজকের এই স্মার্ট ফোনের যুগে AQI তথা Air Quality Index এর কথা জানেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই মাপকের মাধ্যমে বোঝা যায় বাতাসের শুদ্ধতা কিংবা দূষণের পরিমাণ। এই মাপক থেকে জানা যায় বাতাসের মধ্যে মিশে থাকা ক্ষুদ্র কণা (PM2.5), বড় কণা (PM10) অর্থাৎ ধুলো বালি এছাড়াও সোডিয়াম, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং কার্বনের পরিমাণ। এই ক্ষুদ্র কণা আর বড়ো কণাই এখন সর্বাধিক মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে PM2.5 থাকা উচিত 35mg/m3, সেখানে ভারতের নানা শহরে এর পরিমাণ চারশো পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে PM10 এর সর্বাধিক মান থাকা উচিত 150mg/m3 সেখানে এটিও বিপদসীমাকে প্রায়ই অতিক্রম করে ফেলছে। বর্তমানে ভারত ও তার প্রতিবেশী দুই দেশ অর্থাৎ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কাছে বায়ুদূষণ একটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একিউআই বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুযায়ী বিশ্বের এক নম্বর দূষিত শহরের নাম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঢাকার একিউআই স্কোর ১৯৫। বিশ্বে দূষিত শহরের তালিকায় চ্যাম্পিয়ন যদি হয় ঢাকা, রানার্স তবে কলকাতা। কলকাতার একিউআই ১৮৮। ১৮৩ একিউআই স্কোর নিয়ে বিশ্বের তৃতীয় দূষিত শহর ভারতের রাজধানী দিল্লি।
দিল্লিতে বাস করার সূত্রে আজ বলবো দিল্লির কথা। ভারতের রাজধানির কথা। সারা দেশকে পরিচালিত করছে যে শহরটা, যে রাজ্যটা সে কীভাবে বেঁচে আছে তার কথা। ভারতের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত শহরের কথা উঠলে সবাই একসঙ্গে নিশ্চিত উচ্চারণ করে উঠবেন দিল্লির নাম। মূলত বাংলার খবরের চ্যানেলগুলো এভাবেই প্রচার করে চলেছে অবিরাম। কিন্তু দিল্লি ভারতের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকা থেকে নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছে ২০২২ সালে। তাবলে দিল্লির দূষণ কমে গেছে এমন ভাবার কারণ নেই। আসলে ভারতের অন্যান্য শহরগুলি নিজেদের দূষণের মাত্রা দায়িত্ব সহকারে বাড়িয়ে দিল্লিকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। এখন ভারতের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম দশের মধ্যে দিল্লির নাম নেই। দিল্লির চারপাশের রাজ্যগুলোও ভয়ানক দূষিত। দিল্লির ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে উত্তরপ্রদেশের নয়ডা এবং হরিয়াণার গুরগাঁও। দিল্লিসহ পাশাপাশি এলাকাগুলি দিনে একবার করে হলেও AQI লেভেল ৩00 অতিক্রম করে ফেলছে। যা ৫0-এর কম থাকা প্রয়োজন। এবং এরকম অবস্থা চলতে থাকবে মার্চ মাস অবধি যার সূত্রপাত ঘটেছে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে।
কলকাতা বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকার অবস্থাও একই। কিন্তু দিল্লির সঙ্গে সেসব জায়গার ফারাক আছে। কারণ কলকাতা বা তার পাশ্ববর্তী এলাকায় বৃষ্টির পরিমাণ যথেষ্ট বেশি ফলে কিছুদিন অন্তর অন্তর AQI লেভেল কমে যায়। তাছাড়া আগেই উল্লেখ করেছি AQI লেভেল কেবল PM2.5 এবং PM10 এর উপর নির্ভর করে না। অক্সিজেনের মাত্রাও একটা বড়ো ব্যাপার যেটা বাংলার মানুষকে রক্ষা করে। দিল্লির দূষণ অক্সিজেনের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। অক্সিজেন এসময় বাতাসে অনেকটাই কম থাকে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আমি দিল্লি আছি বিবাহসূত্রে। দিল্লির দূষণ যে কতটা ভয়ানক তা প্রত্যক্ষ করছি কেবল এই বছরই অর্থাৎ ২০২২ সালে। এর আগে ২০২০ সালে লকডাউনের কারণে হাজার খারাপের মধ্যে যেটা ভালো ছিল, সেটা হলো পরিবেশ দূষণ মুক্ত ছিলো। ২০২১ সালে এসময়টা তারকেশ্বরের বাড়িতে ছিলাম কিন্তু এইবছরে এখনো পর্যন্ত দিল্লিতেই আছি। দিল্লির দূষণের নানা সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞগণ নানা আলোচনা করেই থাকেন কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে যেগুলির মুখোমুখি হচ্ছি তা রীতিমতো আমার কাছে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুরুটা হয় দীপাবলীর দিন। যতই বলা হোক বাজি নিষিদ্ধ সেদিন দিল্লিতে বাজি পুড়েছে যথেষ্ট। ঘরের দরজা, জানালা বন্ধ রাখা সত্বেও বারুদ পোড়া গন্ধ থেকে মুক্তির কোনো রাস্তা খুঁজে পাইনি। টানা ঘণ্টা খানেক এই গন্ধে থাকার পর নাক বন্ধ হয়ে আসছিল। কিছু পরে কালো কফ উঠল আর মাঝ রাতে শুরু হলো অস্বস্তি, বমি বমিভাব। জগদ্ধাত্রী পূজার আগে থেকে সেই যে সর্দি, মাথা ব্যথা, শুকনো কাশি শুরু হয়েছে তা আজও চলছে। সঙ্গে আছে হাঁচি। মাস্ক ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়াই যাচ্ছে না। চারপাশে তাকালে মনে হয় কুয়াশায় ঢেকে আছে গোটা শহর। মাঝে বাচ্চাদের স্কুল-ও বন্ধ করা হয়েছিলো। রাতে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দমবন্ধ হয়ে আসে। ঘুম ভেঙে যায়। জোরে শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিংবা শুকনো কাশি শুরু হলে যায় থামতে চায়না। এভাবেই চলতে থাকে দিল্লির বাসিন্দাদের জীবন।
এ প্রসঙ্গে আবার উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেহেতু দিল্লি ভারতের রাজধানী তাই দিল্লির খবর প্রচারিত হয়। ভারতের অন্যত্র বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থানের শহর কেবল নয় গ্রামগুলির অবস্থাও একেবারেই ভালো নয়। শহরগুলির দূষিত হচ্ছে গাড়ির ধোঁয়া, ধুলো, ইমারত ভাঙা গড়া, নানা কলকারখানা ইত্যাদি কারণে। এমনকি পাশাপাশি গ্রাম-ও শহরকে দূষিত করছে। এই সময়টায় ধান ও গম ওঠে। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা , পাঞ্জাবে ফসল তোলার পর গাছের নানা অংশ জমিতেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। উল্লিখিত রাজ্যগুলির পাশাপাশি দিল্লিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। একই কারণে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলির অবস্থাও খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে। কঠোর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব নয়।
Feature image is representational.
- লেখক পরিচিতি- ঋতুপর্ণা কোলে। পিএইচডি গবেষক, বাংলা বিভাগ, অসম বিশ্ববিদ্যালয়। দিল্লিতে থাকেন।